মিঃ মজুমদারের ফোন বেজে উঠল ভোরবেলাতেই, ভবানী ভবনের তলব। “আই উইটনেস এসে গেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন।” ফোনটা রেখেই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরোচ্ছেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাবেন। রাস্তায় খুব বেশি জ্যাম না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি তিনি পৌঁছে যাবেন। উত্তর কলকাতার বেশ বনেদি এলাকায় মিস্টার মজুমদারের বাড়ি। পারিবারিক ব্যবসা আছে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ভালো আঁকেন তিনি। আঁকাটা তার নেশা। ভবানী ভবন থেকে প্রায় তলব আসে এবং তখনই ছুটি যেতে হয় তাকে।
বেশ বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত তিনি। শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। একমাত্র ছেলে রকি। স্ত্রী নিভা গৃহবধূ। দিন সাতেক আগে কলকাতার শিয়ালদহ অঞ্চলে একটা বড় ব্যাংক রবারি ঘটেছে। তারই খোঁজ খবর চলছে। ভবানী ভবন অবধি জল গড়িয়েছে।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ভবানী ভবনে। দেখলেন দুজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক বসে আছেন। ওনারা বেলেঘাটা লেক অঞ্চলে মর্নিং ওয়াক করেন প্রত্যহ। তখন ওনারা দেখেছেন অল্পবয়সি কয়েকজন গাড়ি থেকে নামলো। টাকা পয়সা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কথা বলছিল। ওনাদের সন্দেহ হয়। ছেলেগুলোর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে ওনারা সাহস করে কিছু বলতে পারেনি। তাই ভবানী ভবনকে সাহায্য করতে এসেছেন।
মিস্টার মজুমদার একটু রেস্ট নিলেন। ভবানী ভবনের কর্তা ব্যক্তিরা কথা বলছেন ওনাদের সাথে। তারপর মিস্টার মজুমদারকে বললেন, “ওনাদের কথা মতো স্কেচটা বানিয়ে ফেলুন।” মিস্টার মজুমদার প্রাথমিক কিছু কথা জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেগুলোর বয়স কেমন? পরনে কেমন পোশাক ছিল? ওনারা জানালেন, “কারুর বয়সই ১৮ বছরের বেশি নয়। প্রত্যেকেই গেঞ্জি প্যান্ট পরা ছিল। মিস্টার”। মজুমদার বললেন,” বেশ এবার আমি শুরু করছি আপনারা বলুন”।
স্কেচ শুরু করলেন। যে ছেলেটার স্কেচ আঁকছেন, সেই ছেলেটা দোহারা, উল্টো চুল আঁচড়ায়, টিকালো নাক, ফরসা,চোখ দুটো পটল চেরা, ঠোঁটটা একটু চাপা, চোয়ালটা ভাঙ্গা। এই অব্দি শুনে শুনে মিস্টার মজুমদার এঁকে চলেছেন। ওনাদের নির্দেশমতো কোথাও কোথাও রাব করতে হচ্ছে। এই অবধি সব ঠিকঠাক ছিল। এরপর ওনারা বলতে লাগলেন ছেলেটির গলাটা একটু তোলা, কান গুলো পিছনের দিকে খানিকটা চাপা। মিস্টার মজুমদারের মন আতঙ্কিত হয়ে উঠছে।।
নির্দেশ মতন তাই আঁকলেন, তারপর ওনারা বললেন ছেলেটির বাম গালে একটা জরুল আছে। মিস্টার মজুমদার দর দর করে ঘামছেন, হাত থেকে পেন্সিলটা পড়ে গেল। শরীর অসুস্থ বোধ করছেন। ছুটে এলেন অফিসারেরা। চিনতে পেরেছেন আপনি? মজুমদারের ঠোঁট কাঁপছে, কথা বলতে পারছেন না, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। কাঁচের গ্লাসে জল এলো কিছুটা খেলেন চোখে মুখে খানিকটা জল দিলেন। এখন কিছুটা স্বাভাবিক। অফিসাররা চেপে ধরেছেন, ছেলেটিকে চিনতে পেরেছেন আপনি? কোথায় থাকে! সে কি আপনার পরিচিত? এইবার মিস্টার মজুমদার নিজেকে সংযত করে বলেন স্যার ছেলেটাকে আমি চিনি, ও আমারই ছেলে রকি, আপনারা এখনই গেলে ওকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন। একজন অফিসার মিস্টার মজুমদারকে সাধুবাদ জানালেন। লোকাল থানাকে ইনফর্ম করা হলো। এক ভ্যান পুলিশ নিয়ে যাবার নির্দেশ হলো। মিস্টার মজুমদার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
মিস্টার মজুমদার খুব শান্ত স্বভাবের, ঝুট ঝামেলা খুব একটা পছন্দ করেন না। নিভার তত্ত্বাবধানেই ছোটবেলা থেকে রকিব বড় হয়েছিল। ভীষণ জেদ বায়না ছিল রকির। দক্ষিণ কলকাতার নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র। লেখাপড়াও খুব ভালো ছিল। মিস্টার মজুমদার টের পেয়েছিলেন ছেলের অধঃপতনের কথা। প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। দাপুটে স্ত্রী ও বিগড়ে যাওয়া ছেলের যুক্তিতে কিছুই করে উঠতে পারেননি। আজ নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। বউ ও ছেলেকে যদি সময় থাকতে একটু শাসন করতেন তবে হয়তো আজকের দিনটা আর তাকে দেখতে হতো না।
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। সারা পাড়ায় নিঝুম নিস্তব্ধতা। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানের জটলা দেখলেন। বাড়িতে ফিরতে, স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়লেন।মিথ্যা কেসে জড়ানোর যুক্তি খাড়া করতে চাইলেন।এইবার মিস্টার মজুমদার ঠাসিয়ে স্ত্রীকে একটা চড় মারলেন। বললেন, পনেরো বছর আগে যদি এই চড়টা তোমার গালে দিতাম তাহলে আজকের এই দিনটা আসত না। নিভা লুটিয়ে পড়ল মিস্টার মজুমদারের পায়ে। আজ তিনি পাথর হয়ে গেছেন। কোন কিছুই যেন তাকে আর স্পর্শ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অধঃপতন — গোলাম সরোয়ার