অন্যরকম অনুভূতি
এস এম জাকারিয়া
মাহে রমজানের বরকতের দশদিনও প্রায় শেষ। সারা দেশের মত মুরাদপু বিদ্যালয়েও শ্রেণি ককার্যক্রম চলছে। আর মাত্র দুই দিন ক্লাশ চলবে। এরপরই আগামী বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের বন্ধ দেয়া হবে।তাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুশির আমেজ। প্রায় সকল শ্রেণিকক্ষেই ঈদের কেনাকাটা নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকমন্ডলিও তাঁদের পাঠদানের ফাঁকেফাঁকে এই আড্ডায় অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে বলছে কে কত সেট নতুন জামা কিনেছে, কত দামি সেগুলো, কতজোড়া নতুন জুতো হলো। এসব বিষয়ে যেন গাল-গল্পের অন্ত নেই। উক্ত বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণিতেও এমনই গল্প চলছে। সেখানে একজন ছাত্র এসকল গল্পে অন্যদের সাথে অংশ না নিয়ে বরং এক কোণে একলা চুপটি করে বসে আছে। সে অত্র বিদ্যালয়ের সবচেয় মেধাবী কিন্তু দ্বিনহিন শিক্ষার্থী। যে কারণে তার নতুন জামা – জুতো কেনা হয়নি। আর একথা শুনে ক্লাসের অন্যান্যদের সেকি ঠাট্টা-বিদ্রুপ,হাসি – তামাসা আর টিপ্পনী কাটা। সকলে মিলে তাকে গরিব, ছোটলোক বলে উপহাস করতে লাগলো। এতেই তার মন খারাপ, তার খুব হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এরুপ উপহাসকারীদের মধ্যে মারুফ একটু বেশিই করছিলো। কারণও আছে, সে এই বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ধনী ঘরের ছাত্রদের একজন। সেই সুবাদে শ্রেণিতে অন্যান্যদের থেকে তার কেনা নতুন জামা, জুতো জোড়া বেশী। সে গর্বভরে বলছে এবার আমার ৫জোড়া জুতো ও ৮সেট জামা হয়েছে। তাদের এমন জম্পেশ আড্ডার মাঝে হঠাৎ আস সালামু আলাইকুম শব্দে ছেদ পড়লো। তারা দরজায় তাকিয়ে দেখলো সদা হাস্যোজ্বল প্রিয় শাহেদ স্যার ক্লাসে প্রবেশ করছেন। স্যার এসেই বলা শুরু করলেন কেমন আছো সবাই? ঈদের আনন্দে সকলে যে একেবারে আটখানা!! এমনই গল্প চলছে।
সেখানে একজন ছাত্র এসকল গল্পে অন্যদের সাথে অংশ না নিয়ে বরং এক কোণে একলা চুপটি করে বসে আছে। সে অত্র বিদ্যালয়ের সবচেয় মেধাবী কিন্তু দ্বিনহিন শিক্ষার্থী। যে কারণে তার নতুন জামা – জুতো কেনা হয়নি। আর একথা শুনে ক্লাসের অন্যান্যদের সেকি ঠাট্টা-বিদ্রুপ,হাসি – তামাসা আর টিপ্পনী কাটা।সকলে মিলে তাকে গরিব, ছোটলোক বলে উপহাস করতে লাগলো। এতেই তার মন খারাপ, তার খুব হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।এরুপ উপহাসকারীদের মধ্যে মারুফ একটু বেশিই করছিলো। কারণও আছে, সে এই বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ধনী ঘরের ছাত্রদের একজন। সেই সুবাদে শ্রেণিতে অন্যান্যদের থেকে তার কেনা নতুন জামা, জুতো জোড়া বেশী। সে গর্বভরে বলছে এবার আমার ৫জোড়া জুতো ও ৮সেট জামা হয়েছে। তাদের েমন জম্পেশ আড্ডার মাঝে হঠাৎ আস সালামু আলাইকুম শব্দে ছেদ পড়লো। তারা দরজায় তাকিয়ে দেখলো সদা হাস্যোজ্বল প্রিয় শাহেদ স্যার ক্লাসে প্রবেশ করছেন। স্যার এসেই বলা শুরু করলেন কেমন আছো সবাই? ঈদের আনন্দে সকলে যে একেবারে আটখানা!! কিন্তু একি!! নাঈম তুমি এমন মনমরা কেন?? তিনি নাঈমের সামনে গিয়ে তার আনত মুখটি তুলে তার চোখে পানি দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। জিজ্ঞেস করলেন সকলের উদ্দেশ্যে কী হয়েছে?! সবাই চুপ, কারো মুখে কোন উত্তর নেই। স্যার আরো দু’তিনবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর না পেয়ে রেগে গেলেন, অত্যন্ত রুক্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, নাঈম এমন আনন্দের মধ্যেও কাঁদছে কী কারণে? তখন ভয়ে ভয়ে ক্লাসের একজন ছাত্রী ফারিয়া দাঁড়িয়ে স্যারকে সব ঘটনা খুলে বললে স্যার আরো বেশি রেগে গিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থাকলেন মারুফ সহ সবার দিকে। শাহেদ স্যারের এই এক স্বভাব, অধিক রাগলে কোন কথা না বলে শুধু কটমট করে তাকিয়ে থাকেন। এটা বুঝতে পেরে ফারিয়া আরো বলল, স্যার আমি মারুফকে অনেকবার বারণ করেছি এতবেশি না বলতে, কিন্তু সে শুনেনি। স্যারের রাগান্বিত রক্তবর্ণ চেহারা দেখে শিক্ষার্থীরা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।মনেমনে সকলেই একই চিন্তায় অস্থির, আজ না জানি কপালে কী আছে?? এমনিতে শাহেদ স্যার খুবই মজার মানুষ, সহজে রাগ করেন না। কিন্তু কোন কারণে একবার রেগে গেলে আর রক্ষে নেই। তাছাড়া স্যার যখন যে শ্রেণিতে ক্লাস নেন সেখানে তাঁর শিক্ষার্থীদের পাঠ বুঝাতে গিয়ে অনেক মজা করেন। গল্পেগল্পে পাঠ বুঝাতে থাকেন বিধায় কখন যে তাঁর ক্লাস শেষ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা টেরও পায়না। তিনি শ্রেণিতে পাঠ বুঝানোর সময় প্রয়োজনে নবীজীর গল্প, সাহাবাদের ত্যাগের গল্প, বিভিন্ন মনীষীর গল্প, বিজ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন আবিষ্কারের গল্পসহ বিভিন্ন উপমা দিয়ে পাঠ আলোচনা করেন। সেই হাসিমাখা চেহারায় আজ এমন রাগ দেখে যখন সকলে ভয়ে অস্থির, ঠিক তখনি সকলকে অবাক করে দিয়ে স্যার মুচকি হাসলেন। সকলে অবাক হলেও যেন প্রাণ ফিরে পেলো। স্যার বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা মজা করতে গিয়ে এমন করেছো। তবে এমন মজা করা ঠিক নয় যাতে অন্যজন মনে ব্যথা পেয় কাঁদে। কারণ আল্লাহর কাছে এমন ধরণের কান্নার চোখের পানির দাম অনেক বেশী। তাছাড়া আমাদের নবীজী বলেছেন, “তোমরা কারো মনে কষ্ট দিওনা, কারন তুমি কারো মনে কষ্ট দেয়ার পর তুমি অথবা সে দুজনের কোন একজন মারা যায় আর ক্ষমা নিতে না পারে তবে বান্দার হক নষ্ট হওয়ার এ গুণাহ্ আল্লাহ্ কখনো ক্ষমা করবেন না”। স্যার আরো বলেন, আজ তোমাদের আমি রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এর সাথে এতিম বালকের ঘটনাটি বলবো। তোমরা মন দিয়ে শুনো।
সকলে মনযোগী হলে স্যার বলা শুরু করলেন, ” একবার ঈদের দিনে নবী সা. সকাল বেলা ঈদগাহে যাওয়ার জন্য বের হলেন। পথিমধ্যে দেখলেন ছোট্ট একটি বালক কাঁদছে। নবী সা. বালকটিকে কাছে ডাকলেন। বালকটি ভয়ে কাছে আসতে চাইছিলোনা। নবী সা. তাকে অভয় দিয়ে আবার ডাকলেন। এবার বালকটি কাছে আসলেও ভয়ে বকেমন যেন কুঁকড়ে থাকলো। নবী সা. তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? কী হয়েছে তোমার? এমন খুশির দিনে কাঁদছো কেন? বালকটি উত্তরে বলল, আমার বাবা বেঁচে নেই, তাই এমন খুশির দিনেও আমার ঘরে খাওয়ার মত কিছু না থাকাতে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ভূখা আছি।বালকটির মুখে এ কথা শুনে নবী সা. কেঁদে দিলেন। ময়লা ধুলোবালি মাখা এতিম বালকটিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তার হাত ধরে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন।হযরত আয়েশা রা. ডেকে বললেন, ধর! এই বালকটিকে উত্তম রুপে গোসল করিয়ে ভালো জমা পরিয়ে উত্তমভাবে খাওয়া – দাওয়া করাও। আজ হতে সে আমাদের সাথে থাকবে, আমি তাকে সন্তানের মর্যাদা দিলাম।”
স্যার গল্প শেষ করলেও কারো মুখে কোন কথা নেই। কারণ স্যারের বলা গল্প ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মনে দারুন দাগ কেটেছে। বিশেষ করে মারুফের মনে। সে মনেমনে ভাবতে লাগলো, না আজকে নাঈমের সাথে আমার আচরণ মোটেই ভালো হয়নি। সে স্থির করলো ক্লাস শেষে নাঈমের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। বলাতো যায়না, কালকের আগে দুজনের একজন মারা গেলে আর ক্ষমা নেওয়ার সুযোগতো পাওয়া যাবেনা। কিন্তু একি! ক্লাশ শেষ হতে না হতেই নাঈম যে হাওয়া, সে মূহুর্তে যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে! অনেক খুঁজেওতাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। মারুফ সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল যেভাবেই হোক নাঈমের কাছেসে ক্ষমা চেয়ে নিবে। আর নাঈমকে না পাওয়ার একটা কারণও আছে। এই এতটুকুন বয়সের নাঈম কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের খরচ মিটানোতে সহযোগিতার জন্য অন্যের খামারে কাজ করে। বাবা না থাকাতে এবং মা অসুস্থ হওয়াতে তার এ অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা মা ছেলেতে মিলে পরিশ্রম করে কোন রকম সংসার চালাত। গত তিন-চার মাস মাও অসুস্থ হয়ে বিছানা নেওয়াতে সে আরো এক বেলা কাজ নিয়েছে। সকালে অন্যের গরু-মহিষের ঘাস কাটা আর বিকালে ক্লাশ ছুটির পর রুটির দোকানের কাজ। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই তার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক করছে, কীভাবে ছোট দু’বোনের মুখে ঈদের হাসি ফোটাবে? তাদের কী এবার নতুন জামা কিনে দেওয়া সম্ভব হবে? অথচ ঈদের আর নয় দিন বাকী মাত্র।মায়ের রোগের ঔষধ কী সে সময় মত কিনে আনতে পারবে? পরদিন নাঈম একেবারে ক্লাস আরম্ভ হওয়ার আগ মূহুর্তে ক্লাসে প্রবেশ করায় এবং তার পিছুপিছু স্যারও চলে আসায় মারুফ আর কথা বলতে পারলো না। সে একটু অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলো, যেখানে নাঈম পূর্বে ক্লাশ আরম্ভ হওয়ার বেশ আগে এসে হৈচৈ করার জন্য স্যারের বকা শুনতো, সেখানে আজকাল সে কিনা একেবারে স্যারের সাথেই ক্লাসে প্রবেশ করে! স্যারেরা তাকে এ্যাসেম্বলিতে না থাকলেও বকাঝকা করেন না ! এমন কী হলো তার, কেন সে এতটা গম্ভীর ও মনমরা হয়ে গেলো ? মারুফের মনে দৃঢ় সংকল্প হলো তাকে এসবের কারণ জানতে হবে। সে গিয়ে নাঈমের পাশে বসলো যেন আজ কোন এক ফাঁকে গতকালের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যায় এবং তার অবস্থার কথাও জেনে নেয়া যায়। কিন্তু না, মারুফ কোন কথা বলার সুযোগ পেলনা। সে ভাবলো, বিরতিতে কথা বলে নেয়া যাবে। কিন্তু বিরতিতে নাঈম কি কাজে যেন তাড়াহুড়ো করে কোথাও চলে যাওয়াতে সে সময়ও হলোনা। বিরতি শেষে আবার সময় মতোই হাজির। মারুফ এবার একরকম জোর করেই নাঈমের সাথে কথা বললো। তাকে বিরতির সময়ে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলো এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে কোন উত্তর না দিয়ে বরং উল্টো রাগ দেখিয়ে বললো, তা জেনে তুমি কী করবে? মারুফ যখন দেখলো নাঈম কোন উত্তর করবেনা, তখন সে আর কথা বাড়ালো না।
তাছাড়া ক্লাসে শিক্ষকও এসে গেছেন দেখে সে পাঠে মন দিলো। বাকী ক্লাসগুলো শেষ হওয়ার পর ছুটির ঘন্টার সাথেসাথে মারুফ নাঈমের হাত খফ্ করে ধরে ফেললো, বলতে লাগলো ভাই গতকাল আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি না বুঝে, না জেনে। আমাকে ক্ষমা করে দাও, তুমি ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি মনে শান্তি পাচ্ছিনা। নাঈম বললো, সে আমি গতকাল স্যারের গল্প শোনার পরই সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি, যখন তোমরা সকলে স্যারের কাছে নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছো। এবার মারুফ তাকে বন্ধু হওয়ার প্রস্তাব দিলো। নাঈম বললো আমরা সহপাঠী আছি এটাই তো যথেষ্ট। তাছাড়া আমার আর তোমার মাঝে অনেক পার্থক্য। কিন্তু মারুফতো নাছোড়বান্দা, জীবনে আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। অথচ আজ কিনা নাঈমের বন্ধু হতে পারবেনা ! নাঈমের এমন জেদি আচরণের কারণে শেষ পর্যন্ত মারুফ রাজী হতে বাধ্য হলো। এবার নাঈমকে মারুফ চেপে ধরলো তার সমস্যা কী তা বলার জন্য। কেন সে সকালে ক্লাসে এত দেরী করে? কেন বিরতিতে সবার সাথে খেলাধুলো না করে কোথাও চলে যায়? আর কিসের এত তাড়া থাকাতে ছুটির ঘন্টা বাজতে না বাজতেই সে উধাও হয়ে যায়? কেন এখনো তার নতুন জামা জুতো কেনা হয়নি? নাঈম প্রথমে কোন উত্তর দিতে পারলো না, বরং তার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এল। নিজকে সামলে নিয়ে চোখের পানি আড়াল করলো বন্ধু মারুফ থেকে। মারুফ খুব বেশি পিড়াপীড়ি করতে লাগলে নাঈম তাকে বললো, চলো তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে তুমি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। মারুফ বললো না, আজ নয়। মাকে বলে এসে কাল যাবো। কিন্তু পরদিন মারুফ তার মায়ের অনুমতি নিতে ভুলে গেলেও নাঈমের সাথে সে গেলো, কারণ মনে জাগা প্রশ্নগুলো তাকে কোন কাজে মন বসাতে দিচ্ছেনা। মানসিকভাবে চরম অস্থিরতার মধ্যে আছে সে।
নাঈমের বাসায় গিয়েতো মারুফের অবস্থা আরো কাহিল, এটা বাসা ! এটাকে বাসা বললে তাদেরটাতো বালাখানা। এতো বাসা নয়, বরং পায়রার খোপের মত ছোট্ট একটা বস্তির ঝুপড়ি ঘর মাত্র। তার আবার ছন – পলিথিন দেয়া ছাউনিটাও মাঝেমাঝে ফুটো। মারুফের তখনই মনে পড়ল, নাঈম একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল – গরীব ঘরে জন্মালে কী হবে? তারা ঘরে শুয়েই চাঁদ ও আল্লাহ্ দেখতে পায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে যা দেখলো সে তা হলো, এক কোণে দড়িতে আধ – পুরান কিছু কাপড়, কিছু ছেড়াফাড়া কাপড় সুন্দর করে গুছানো, তার পাশে ছোট একটা নড়বড়ে টেবলে বেশ অনেক প্রকারের বই যেগুলোর বেশির ভাগই ক্লাসের বই নয়। অন্য প্রান্তে স্যাঁতস্যাঁতে মেছেতে চাটাই বিছানো, তার উপর ছেঁড়াফাড়া মাদুর পেতে একজন মাঝবয়সী মহিলা শুয়ে কাতরাচ্ছেন। মারুফের বুঝতে কষ্ট হলোনা ইনিই হলেন নাঈমের মা। সালাম দিলো সে মহিলাকে। নাঈম তার মাকে বললো, মা! গতকাল তোমাকে মারুফের কথা বলেছিলাম না, এই হলো মারুফ। সে আমার অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাক বেশি জালাতন করছিলো বলে আমি তাকে নিয়ে এসেছি এই বলে নাঈম বাইরে চলে গেলো। নাঈমের মা উম্মে হাফসা বলতে শুরু করলেন, আর মারুফ তা বাধ্য ছাত্রের মত শুনছিলো।
নাঈমের বাবা মারা যাওয়া, নাঈম ও তার মা পরের কাজ করা, মা অসুস্থ হওয়ায় নাঈমের দু’জায়গায় কাজ করে পাশাপাশি লেখাপড়া করা ইত্যাদি শুনতে শুনতে মারুফের কখন যে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছিল তা সে টেরই পেলোনা। তার বুঝতে বাকী রইলোনা, কেন নাঈম সকালে দেরিতে স্কুলে যাওয়ার পরও স্যারেরা বকেন না আর কেনইবা সে ক্লাশ শেষ হওয়ার সাথেসাথে তাড়াহুড়ো করে স্কুল থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু এখনো তার মাথায় এটা কোন ভাবেই ঢুকছেনা নাঈম টিফিনের সময়ে কি করে, কোথায় যায় ? এ সম্পর্কে কৈ তার মাওতো কিছুই বললেন না ! ঠিক এমন সময়ে নাঈম ঘরে ফিরে আসলে মারুফ তাকে তার মায়ের সামনে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলো। নাঈম একটু চমকে উঠলো কারণ সে বিষয়টা তার মায়ের কাছ থেকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আজ আর পারলো না। সে বললো বিরতির ঐ ৪৫ মিনিট সে স্কুলের দরজায় করিম চাচার চা দোকানে কাপ-পিরিচ ধোয়ার কাজ করে বিনিময়ে দুপুরের নাস্তা ও মায়ের ঔষধের টাকা পায়। একথা শুনে মারুফ আবার কেঁদে দিলো, সাথে নাঈমের মাও কাঁদলেন। এবার মারুফ তার বন্ধু নাঈম ও তার মা থেকে বিদায় নিয়ে চিন্তিত মনে দ্রুত বাড়ির পথ ধরলো। তার মনে ভয় কাজ করছে একথা চিন্তা করে যে আজ এত দেরী হওয়ায় নাজানি কত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ? হয়তোবা কটু কথাও হজম করতে হবে।
এমনিতে বাড়িতে তাকে কেউ তেমন একটা না বকলেও সে তার মাকে ভীষণ ভয় করে। সে সবার সাথে এক-দুইটা মিথ্যা বললেও তার মায়ের সাথে বলতে পারে না। কিন্তু না, সে বাড়ি ফেরার পর কেউ তেমন কিছু বললো না।কিন্তু নাঈমদের ঘরে যাওয়ার পর তার মনের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে তা তাকে সারারাত নিশ্চন্তে ঘুমাতে দেয়নি।রাতভর এপাশওপা করে প্রায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে সকালে সে ফজর সালাত জামায়াতে পড়লো, মুনাজাতে অত্যন্ত নরম হয়ে আল্লাহর দরবারে সিদ্ধান্ত নিতে পারার জন্য কান্নাকাটি করে দোয়া করল। এরপর সে সিদ্ধান্ত নিলো কপালে যা আছে হবে, সে তার এবারের ঈদের সবচেয়ে সুন্দর জামা সেট ও জুতো জোড়া নাঈমকে উপহার দেবে। পাশাপাশি শাহেদ স্যারের সাথে পরামর্শ করে ক্লাসের সবার থেকে চাঁদা তুলে একটা ফান্ড তৈরী করবে। তা দিয়ে নাঈমের ঘরে দেখে আসা তার ছোট দু’বোনের জন্য জামা, তার মায়ের জন্য শাড়ি ও ঔষধের ব্যবস্থা এবং তারা পরিবারের সবই যেন অন্যান্যদের মত সেমাই-চিনি রান্না করে তা খেয়ে মিষ্টিমুখ করে আনন্দ করবে সেই ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এসব করতে হবে নাঈমের অজান্তেন, না হলে সে অপমান বোধ করতে পারে।
যেই ভাবা সেই কাজ, পরেরদিন বিদ্যালয়ে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করলো সে। স্যারকে সব খুলে বলে তাঁর কাছে এই কাজের জন্য সাহায্য চাইলো। আরো বললো যা করার আজই করতে হবে, কারণ আজই ঈদের বন্ধ হয়ে যাবে। স্যার বুদ্ধি করে পুরো বিদ্যালয় জুড়ে একজন চরম বিপদগ্রস্ত লোকের সাহায্যের প্রয়োজন, এমন ঘোষণা দিলেন। সব শ্রেণির প্রতিনিধিদের দিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করে একটা মজবুত ফান্ড গঠন হয়ে গেলো খুবই অল্প সময়ের মধ্যে। মারুফতো মহা খুশি তার পরিকল্পনা মতো কাজ হচ্ছে দেখে। সে নিজেও তার নানার দেওয়া পনেরোশ টাকা দিয়ে অংশ নিলো, এমনকি নাঈমও নিজের কষ্টে আয় করা টাকা থেকে পঁচিশ টাকা দিয়ে এই ফান্ডে অংশ নিলো। এতে স্যার এবং মারুফ কোনো বাধা দিলো না। এবার নাঈমদের পরিবারের জন্য শপিং করার পালা। স্যারের পরামর্শে মারুফ তার শ্রেণি বন্ধু আহাদ, আজাদ, বেলাল, ও আবু বকরকে শিক্ষক রুমে ডেকে নিয়ে সম্পূর্ণ বিষয় বুঝিয়ে বলল এবং একটা কমিটি গঠন করলো। সাথে তাদের বলা হলো নাঈম যেনো ঘূর্ণাক্ষরেও টের না পায়। স্যারকে বাস্তবায়ন কমিটির উপদেষ্টা ও মারুফকে প্রধান করে কাজ এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। স্যারের কাছে জমা রাখা সংগৃহীত টাকাগুলো নিয়ে ৫ম শ্রেণির নির্ধারিত এই শিক্ষার্থীরা স্যারের সাথে ঠিক ঈদের আগেরদিন বাজারে গিয়ে পরিকল্পনা মতো নাঈমের পরিবারের সবার জন্য ঈদ শপিং করা হলো। সাথে জোগ করা হলো মারুফের পাঞ্জাবি সেট ও জুতো জোড়া। সব নিয়ে স্যারসহ নাইমের বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের হাতে তুলে দিলো মারুফ। সাথে সংগৃহীত টাকার বেঁচে যাওয়া অংশ তাঁর চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিলো মারুফ। নাঈমের মা উম্মে হাফসা দু’হাত তুলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং স্যারসহ মারুফ ও তার বন্ধুদের জন্য দোয়া করলেন। নামের ছোট দু’বোন নতুন জামা পেয়ে খুশিতে নাচানাচি শুরু করে দিলো। তাদের খুশি দেখে স্যার ও মারুফরাও খুশি হলো। মারুফ ভাবলো এখন তারা বন্ধুরা সবাই মিলে ঈদের আনন্দ করবে, তাতে নাঈমকে জামার জন্য কেউ আর ছোট করতে পারবে না। এদিকে নাঈম তার বিকালের খামারের ডিউটি শেষ করে বাড়িতে ফিরে স্যার এবং মারুফ ও বন্ধুদের এমন কাজ দেখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরে স্যারকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই কান্না কষ্টের নয়, বরং আনন্দের, মহা কিছু পাওয়ার, হঠাৎ পাওয়া আনন্দের, আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের। স্যার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।
অন্যদিকে মারুফের বাড়িতে চলছে তার বিরুদ্ধে শালিসি আয়োজন। তার বাবা বাড়িতে এসেছে।তার মা বিচার দিলেন, ছেলে আজকাল বেশ অনিয়ম করে বাড়ি ফিরছে, যত্রতত্র চলে যাচ্ছে। সময় নেই, অসময় নেই, বলা নেই, কওয়া নেই হুটহাট বাইরে চলে যাচ্ছে। তার উপর আবার তার নানার দেওয়া পনেরোশ টাকা ও তার খালার দেওয়া নতুন জামা ও জুতো জোড়া কাকে যেনো দিয়ে এসেছে! কাকে দিলো? সে-ই বা এভাবে কোথায় যায়? মারুফ বাড়ি ফিরতে দেরী, প্রশ্ন আসতে দেরী নেই। দাদা, বাবা, মা, ফুফু সকলে মিলে প্রশ্নে প্রশ্নে তার অবস্থা জেরবার। সে কারো প্রশ্নের কোনোই উত্তর না দেওয়ায় সকলে মিলে এলোপাতাড়ি তাকে বকাবকি করছে। সে নিরবে সব বকুনি সহ্য করে নিলো। পরদিন যথারীতি ঈদের বিকালে শাহেদ স্যার তাদের বাড়ি আসলেন অন্যান্য বারের মতো। মারুফের বাবা-মা দু’জনে মিলে তার গত কয়েকদিনের সকল কার্যকলাপের কথা স্যারের কাছে অভিযোগ করলেন, বিচার দিলেন। স্যার শুনে মুচকি হাসি দিয়ে মারুফের নেওয়া মহৎ উদ্যোগের কথা জানালেন। কীভাবে মারুফের নেওয়া ছোট একটা পরামর্শ অনেক বড় একটা কাজ হয়েছে তার আদ্যোপান্ত তাদের খুলে বললেন। শুনে মারুফের বাবা-মা উভয়ে যারপরনাই খুশি হলেন, আনন্দে তাঁদের চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে। তাঁরা নিজেদের কলিজার ধনকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করলেন, দাদা মন ভরে দোয়া করলেন। মারুফ চিন্তা করলো, এবারের ঈদই তার জীবনের সেরা ঈদ। এবারকার ঈদ আনন্দ ও অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মা-বাবার খুশি, দাদার দোয়া, নাঈম ও তার পরিবারের ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে আনন্দময় ঈদ সব মিলিয়ে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। এটা সারা জীবন মন-মগজে গেঁথে থাকবে। এদিকে বাবার হঠাৎ সিদ্ধান্ত, আজকের যত ঈদ স্পেশাল রান্নাবান্না ফির্ন্নি, পায়েস, সেমাই নিয়ে সকলে মিলে নাঈমদের ঘরে যাবে এবং তাদের সাথে আনন্দ উল্লাস করে খাবে।এটা শুনে মারুফের আনন্দানুভূতি আরো কয়েকগুণ হলো।
মারুফ এবার বড় একটা মিশন নিয়ে চিন্তা করলো। সে চিন্তা করলো, স্যারের পরামর্শ নিয়ে বন্ধুদের সহযোগিতায় একটা সামাজিক কর্মীদল গঠন করবে। যাদের কাজ হবে, এমনই হাজারো দুঃস্থ, অসহায়, হতদরিদ্র বিশেষ করে পথশিশুদের সাহায্য করা, তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা যেন তারাও যোগ্য নাগরিক হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারে।
লেখক : সহ সুপার, চিশতিয়া বজল আহমদ ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা, মীরসরাই, চট্টগ্রাম।