কিছু ভুল তোমারো ছিলো
জাকির আলম
তখন বর্ষাকাল। চারদিকে কানায় কানায় থৈ থৈ পানির আনাগোনা। শ্রাবণের বারিধারা অবিরাম লেগেই আছে। মাঝেমাঝে কড়া রোদ। মেঘ ভেসে যায় সুদূরের টানে। পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েই চলছে। কোথাও বানের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু। নদীর ভাঙনে কারো ঘর-বাড়ি ভেসে যাচ্ছে। পশুপাখির বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। জমির ফসল ডুবে যাচ্ছে। দিন মজুরের কাজ কাম বন্ধ। গরিব মানুষের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। পেটের ক্ষুধায় ঘুমাতে পারছে না দিন মজুরের সন্তান। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের মাথায় চিন্তার বোঝা। কারো কপাল থেকে চিন্তার রেখাপাত স্পর্শ করে অবিরাম ঘাম ঝরছে। কারো বসতি বাড়ি ডুবে গেছে। ছেলে সন্তান নিয়ে কষ্ট আছে গরিব মানুষগুলো। বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেকে মৃত্যু বরণ করছে।
বিদ্যালয় মুখী ছেলে-মেয়েদের নিয়মিত শ্রেণী কক্ষে উপস্থিত থেকে পাঠ গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। ফলে অনেকেই লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে। কারো বা লেখাপড়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খবরের কাগজ জুড়ে গরিব মানুষের আহাজারি। রাজনীতিবিদরা অভাবগ্রস্থ মানুষকে ত্রাণ দেওয়ার নাম করে মেরে দিচ্ছে সরকারি অর্থ সম্পদ। নিজের পকেট ভারি করছে। সেদিকে প্রশাসনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছে দলীয় রাজনীতিবিদরা। সেই সময় তোমার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক থাকলেও দিন দিন সম্পর্কের ভাটা পড়ছে। প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে সন্দেহ করছো। কখনো বা যোগাযোগ বন্ধ করে রাখছো। কয়েক দিন খোঁজ মেলে না তোমার। আবার হঠাৎ করেই একদিন ফোনে মেসেজের মাধ্যমে সাড়া দাও। দেখা করতে বললেই অজুহাত দেখাও। অথচ তোমাকে বিয়ে করবো বলে আগেই তোমার বাবা-মাকে জানিয়েছি অন্য কারো মাধ্যমে। সেই দিক থেকে তুমি আমার ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছিলে। শুরুর দিকে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই চলছিলো। কিন্তু বছর পেরোতেই সম্পর্কের মাঝে তোমার ত্রুটি দেখতে পাই। কেমন যেন হেঁয়ালি করছো। সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার ভান করছো। অথচ তখনো আমি জানিনা তুমি অন্য কারো হতে যাচ্ছো। সুন্দরের অহংকারে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার প্রত্যয়ে দিন দিন তোমার অবহেলা বেড়ে চলছে আমার প্রতি। আমি যতোই তোমার সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চেয়েছি ততোই তুমি অভিনয় করেছো। আমার প্রতি তোমার আক্রোশ বেড়েই চলেছে। আগের মতো দেখাও দিচ্ছিলে না। দেখা করতে বললেই নানান বাহানা করতে। অথচ এক সময় একদিন দেখা না করলে অস্থির হয়ে যেতে।
আমার সাথে অভিমান করতে। রাগ করে কথাও বলতে না। না খেয়ে দিন-রাত পার করতে। নিজের যত্ন নিতে না। মরে যাওয়ার ভয় দেখাতে। সেই তুমি একটা সময় পর বড় অচেনা হয়ে গেলে। আমি মিলাতে পারছিলাম না তোমার ব্যবহার। এমতাবস্থায় একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ফোনের মাধ্যমে তুমি জানিয়ে দিলে তোমার নাকি অন্য ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোমার সেই কথাটি শুরুতে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এক সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। ছেলেটি নাকি কুরআনের হাফেজ। মসজিদে ইমামতি আর ছোট বাচ্চাদের কুরআন শিক্ষা পেশায় নিয়োজিত। তাকে পেয়ে আমার কথা ভুলে গেলে। অথচ চিঠির ভাষায় এবং মুখে বলেছিলে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তুমি বিয়ে করবে না। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। অথচ সময়ের ব্যবধানে ঠিকই তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে। মিথ্যে অপরাধে আমাকে তুমি অপরাধী বানালে। অপমান করতেও ভুল করলে না। এক পৃথিবী মিথ্যে অভিযোগে আমাকে তুমি অপরাধী সাব্যস্ত করলে। অথচ আমার প্রতি এতোটুকুও সহানুভূতি দেখালে না। একটি বারের জন্যও ভেবে দেখলে না তোমাকে ছাড়া আমি কতোটা অসহায়। স্বার্থপরের মতো আমাকে তুমি দূরে ঠেলে দিলে। তোমাকে হারানোর কষ্টে মাথায় যেন পুরো আকাশ ভেঙে পড়লো। রাতের ঘুম হারাম হলো। খাবার প্রতি চরম অনীহা। শরীর স্বাস্থ্য ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে চোখের জলে ভিজে যাচ্ছি। বুকের ভিতর চাপা আর্তনাদে বিরহের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছি। নিজের প্রতি চরম অযত্নবান হয়েছি। বারবার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে আত্মহত্যার মাধ্যমে ওপারে চলে যাই। মাথায় কষ্টের বোঝা নিয়ে বেঁচে আছি একলা আমি। অথচ সে সবে তোমার কোনো ক্রন্দন নেই। বরং নতুন মানুষের সাথে প্রেমে মগ্ন তুমি।
শুনেছি ছেলেটা হুজুর হলেও রোমান্টিকতায় ভরপুর। প্রতিদিন তোমাকে রোমাঞ্চকর কথা বলে ভুলিয়ে দিয়েছে আমার কথা। বাসর রাতে কি করবে, কেমন করে তোমাকে ভালোবাসবে, তোমার যত্ন নিবে সেই কথায় আমার কথা তুমি একদম ভুলে গেলে। তখন তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইলে বাবা-মায়ের ভয় দেখাতে। নানান অজুহাতে আমাকে তুমি পদানত করতে। তোমাকে ছাড়া থাকতে না পেরে বললাম চলো পালিয়ে বিয়ে করি ! বিপরীতে তুমি বললে এটা আমার পক্ষে করা কখনো সম্ভব না৷ পালিয়ে বিয়ে করলে নাকি কখনো তোমার বাবা মেনে নিবে না। তোমার বাবার রাগের কাছে তুমি হেরে গেলে। আমার কথা ভাবার অবসর নেই তোমার। তোমার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। তার মাঝেই তোমার সাথে কথা বলতে কতো না চেষ্টা আমার। অনেক কষ্টের পর যখন তোমার সাড়া পেতাম একটু হলেও ভালো লাগতো। দীর্ঘ দিন তোমার সাথে কথা বলতে বলতে অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। তাই হঠাৎ করে তোমার সাথে কথা বন্ধ হয়ে গেলে বুকের ভিতর ভীষণ অস্থিরতা ভর করে। তখন যতোই আমি তেমার সাথে যোগাযোগ করতে চাই তুমি ততোই এড়িয়ে যেতে থাকো আমাকে। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। শরীর জুড়ে হিজাব আর মুখে নেকাপ থাকায় তোমার মুখ দেখতে পেতাম না। দু’চোখ বেরিয়ে থাকলেও অন্য মুখ করে আমাকে এড়িয়ে যেতে। কথা বলতে চাইলেও কখনো সুযোগ দাওনি। প্রতিদিন মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার পথে তোমাকে আড়াল থেকে অথবা সামনে থেকে দেখার চেষ্টা আমার বৃথা হতো। কখনো বুঝতে পারিনি এতোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে তুমি৷ হুজুর ছেলেটার ভালোবাসা পেয়ে পুরোপুরি ভুলে গেছো আমাকে। এভাবে চলতে চলতে সতেরো ডিসেম্বর, রোজ শুক্রবার তুমি হুজুর ছেলেটার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে। অথচ এই বিয়েটা আমার সাথেই হওয়ার কথা ছিলো। তোমার বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি থাকায় তোমার বিয়ের আয়েজন নিজ চোখে দেখতে পারাটা যে কতোটা কষ্টের ছিলো ভাষায় বলে বুঝাতে পারবো না। অবশেষে কবুল বলার মাধ্যমে অন্যের হয়ে গেলে চিরতরে আমাকে পর করে। বিয়ের দিন অবশ্য তুমি কৃতকর্মের জন্য ফোনে মেসেজের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছিলে।
কিন্তু তোমার সেই ক্ষমা চাওয়ার মেসেজটা বড্ড হেঁয়ালি গোচের ছিলো। যা মুখে বলতে পারছি না। তারপর শুরু হলো তোমার সুখের জীবন। বিপরীতে প্রতি মুহূর্তে আমি ধুকে ধুকে মরছি। বিয়ের দু’বছর না পেরোতেই তুমি কন্যা সন্তান জন্ম দিলে৷ অথচ এই সন্তান আমাদের হওয়ার কথা ছিলো। সেটা আজ তোমাদের হয়েছে। মাঝখানে শুধু আমি নেই। এতোদিন পরে ফেসবুকে জানলাম তেমন সুখী তুমি হওনি। স্বামীর কড়া শাসন আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ তুমি। নিজের মতো চলতে বাঁধা। এতোদিনে আমাকে তুমি বুঝতে পেরেছো। এখনো আমি বিয়ে করতে পারিনি। কাউকে আর আমার জীবনে প্রবেশ করতে দেইনি। এখনো তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু সেই ভালোবাসা আর তোমার সাথে বিনিময় করতে পারিনা। নিজের মাঝেই রেখে দিয়েছি। জানি কখনো ফিরবে না তুমি। তোমার অপেক্ষায় থাকি তাও না। নিজের মতো করে কোনো রকম বেঁচে আছি শুধু। কোনো অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। তুমি ভালো থাকো এটা আমার কাম্য। কিন্তু তোমার জন্য আমার অনেক আফসোস হয়। তোমাকে ভুলতে পারিনা।
সারাক্ষণ তোমার ভাবনায় মগ্ন থাকি। পুরনো স্মৃতিগুলো মনে হতেই ঝরঝরিয়ে জল বেরিয়ে আসে দু’চোখের ভিতর থেকে। এখনো কোনো ভাবে তোমাকে দেখলে বুকের ভিতর ঝড় ওঠে। যতোদিন তোমার হুজুর স্বামীর সাথে ঘুরতে দেখেছি কাঁপন উঠেছে হৃদপিণ্ডে। জানিনা আমাকে দেখে তোমার কেমন লেগেছে৷ এতোকিছুর মাঝেও জানতে পারলাম আমাকে নাকি তুমি খুব মিস করো। কথা বলার জন্য অপেক্ষায় থাকো। কিন্তু কোনো এক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর ফোন করতে পারো না। কথা বলতে পারো না। যতোটা অভিমানে তুমি অন্যের হয়েছিলে এখন নাকি অনুশোচনা হয় তোমার। অথচ তুমি চাইলেই আমার হতে পারতে৷ বিয়ের পরেও তোমাকে আসতে বলেছিলাম আমার কাছে। তাও তুমি আসোনি। বরং অন্যের সন্তানের মা হয়ে গেলে তুমি। হাজারো ভুলে আমাকে তুমি দোষী বলে সাব্যস্ত করেছো। কখনো ভেবে দেখোনি তোমারো কিছু ভুল ছিলো আমাকে হারানোর পিছনে। অভিমানটা কমিয়ে আমার কাছেই তুমি থেকে যেতে পারতে৷ অথচ সেটা করোনি। আমার উপর চরম প্রতিশোধ নিতেই অন্যের হয়েছো৷ বিপরীতে তুমিও কম কষ্ট পাওনি৷ কিন্তু সে কষ্ট তোমাকে কষ্ট দেয় না। আমাকে পরাজিত করাটাই তোমার মূল পদক্ষেপ ছিলো। সেটা করতে ব্যাপক ভাবে সফল হয়েছো তুমি।
আমিও স্বীকার করি তোমাকে হারানোর পিছনে অজানা কোনো ভুল আমারো থাকতে পারে। একটা সময় পর তুমিও জেনেছো কিছু ভুল তোমারো ছিলো। দু’জনার ভুলে আজ আমাদের পৃথিবী দ্বি-খণ্ডিত। কেউ কারো মুখাপেক্ষী নই। যে যার পথে অবিরাম চলমান। কারো উপর কারো কোনো হস্তক্ষেপ নেই। যে যার মতো অবাধ স্বাধীন। অভিমান অভিযোগের কোনো জায়গা নেই। তবুও আমরা দূর থেকেই ভালোবাসি একে অন্যকে। শুভ কামনা জানাই অন্তর থেকে। আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করি নতুন দিনের প্রত্যয়ে। ভালোবাসি জগতের সমুদয় অস্তিত্বকে।