“বিকালের পড়ন্ত বেলায় আমি আর এমিলি মানে (এমিলি এমারসন ডিসুজা) যখন রেলের ছোট্ট হল্ট স্টেশনটায় পৌঁছালাম , তার আধঘন্টা আগে দিনের শেষ ট্রেন টা চলে গেছে শেষ যাত্রী নামিয়ে, সঙ্গত কারণেই স্টেশন মাস্টার ও ফিরে গেছে নিজের বরাদ্দ রেল কোয়ার্টারে, পড়ে আছে পরিত্যক্ত নিঃসঙ্গ স্টেশন, যেন সবুজ সমুদ্রের বুকে একচিলতে উপকূল,।
লাল মোরাম বিছানো ছোট প্লাটফর্ম , মাথায় টিনের ছাউনি দেওয়া, গোটা চারেক কাঠের সবুজ রং করা বসবার বেঞ্চ, আমরা বসলাম এক জারুল গাছের নিচে একটা বেঞ্চে, দূর দূর পর্যন্ত কোথাও তৃতীয় কেউই নেই। এটা মিটার গেজ আর বডগেজ রেল লাইন। বেশ নিরিবিলি। আর বেশ নির্জন।
আকাশে মেঘ সেজে গুজে তৈরি ছিল অনেক আগে থেকেই, এবার ছমছম করে নেমে এল বৃষ্টি হয়ে।
এসো মেঘ আজ বিকেলের এই নিরালায়
এসো মেঘ আজ বৃষ্টির গল্প বলো,
বহুদিন পর আমাদের এই শহরে
আষাঢ়ের মনখারাপের বৃষ্টি হলো।
“আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি তে ভিজতে ভিজতে এমিলি গান করছে পর্তুগিজ ভাষায়, দুহাত ছড়ানো, মুখ আকাশের দিকে , চোখ বন্ধ। আমি বসে বসে ওর রকম সকম দেখছি, এ মেয়ের নির্ঘাত নাট বল্টু ঢিলে আছে! নাহলে মাথায় তারের ঝালামুখ খুলে গেছে! নাহলে কোন উজবুক সাধ করে বৃষ্টি তে ভেজে, মনে মনে বললাম….
” হাও সুইট! হাও সুইট! সো রোমান্টিক! এই ,শু.. ন.. ছো!? চেঁচিয়ে বললো এমিলি। আরে এসো না, একটু ভিজি দুজনে, ! এমিলি উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ালো প্লাটফর্মের একদম ধারে। আর আমি মাথা বাঁচাতে ছাউনির নিচে এসে বসলাম, এমিলি হাতছানি দিয়ে ডাকছে , আরে এসো। কি হলো তোমার!?
আমি ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালাম, চেঁচিয়ে বললাম এবার চলে এসো, ফিরতে হবে। ও দৌড়ে ফিরে এলো, আমার হাত ধরে টেনে বললো চলো না, ভালোবাসার প্রথম বৃষ্টি তে ভিজে যাই দুজনে !
শেষমেষ হতাশ হয়ে ধপ করে আমার পাশে বসে বলল,
ধুস, তুমি না …., তুমি না…একটা ভীষণ ইয়ে । একটা… একটা…..আন রোমান্টিক; ধুর ভাল্লাগে না!…..
আমি হাসতে হাসতে ওর দিকে তাকালাম, অসময়ে বৃষ্টি তে ভেজার মধ্যে কতটুকু রোমান্টিক ব্যাপার আছে বলতে পারবো না, কিন্তু ওর কোঁকড়ানো একরাশ বাদামী চুল থেকে চুঁইয়ে পরা বৃষ্টির কনা ওর গোলাপী গাল বেয়ে হাত ধরাধরি করে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছিল, ডীপ ওসান ব্লু রং এর টপ । আর কিছু বৃষ্টি বিন্দু সাময়িক বিশ্রাম নিচ্ছিলো ওর নাকের ডগায় , কপালে, থুতনিতে। নাকের হীরের লবঙ্গ ফুলটার উপর এক কুচো বৃষ্টি বসে আছে , বেশ বহাল তবিয়তে। বেশ মোহময়ী লাগছে এমিলি কে।
সৌন্দর্য যেন বৃষ্টি বিন্দু হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পিছলে নামছিল ওর মোমের মতো মসৃণ গোলাপী গাল বেয়ে, যেন গোলাপের মখমলি পাপড়ি হতে টলটলে শিশির কুচি ছলকে ছলকে পড়ছে । যেখানে আমার মুগ্ধতা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, রাস্তা ভুল করে। কিংবা মুগ্ধতা লুকিয়ে নতুন করে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
” কি দেখছো ওমন করে!? মুগ্ধতার রেশ কাটলো এমিলির কথায়। অন্যমনস্ক ভাবে বললাম ” হাঁ, কি বলছো !?
এমিলি এবার ফিসফিস করে বলল, ওভাবে দেখছো কেন? আমার বুঝি লজ্জা করে না!?
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা এমিলি,
“আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না!?
ধুস, এটা আবার বলার মতো কিছু! বাসিই তো…….
হেসে বললাম, ” কতখানি!?
ও উঠে দাঁড়াল, দুহাত প্রসারিত করে দুদিকে, আকাশের দিকে চোখ তুলে বলল ” এই এত্ত খানি”
হেসে বললাম, আর!?
এমিলি আমার কাছে এসে , বসে ভিজে যাওয়া পোশাকে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এত্ত খানি”
দুষ্টুমি হাসি তে বললাম, আর!?
এমিলি আমার গালে ওর বৃষ্টি ভেজা ঠোঁট ছুঁইয়ে অস্ফুটে বলল………
“ভালোবাসি”….. এত্ত খানি…..
আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সন্ধ্যা ও ঘনিয়ে এসেছে, এমিলি ছুটে প্লাটফর্মের ধারে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দুদিকে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে উঠলো ” পর্তুগিজ ভাষায়, “য়ু আমু ভসি ”
সাক্ষী হয়ে থাকলো, ঘনিয়ে আসা ঘুটঘুটে সন্ধ্যা, পরিত্যক্ত নির্জন রেল স্টেশন, মন কেমনের মৌনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছ গুলো, আর বিরহের বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা নিঃসঙ্গ প্রেমিক বেঞ্চ গুলো।
আর এমিলি! এই মাত্র ছড়িয়ে দিল “প্রেম ”
গোলাপের মখমলি পাপড়ির মতো। হলুদ সোডিয়াম ভেপার আলোয় ভিজে যাওয়া সোনালী রেশমী জরির মতো ,
ফোঁটায় ফোঁটায় , আকাশ থেকে নেমে আসছে ভালোবাসা।
কোন এক গোধূলি সন্ধ্যায় — গোলাম সরোয়ার