জাহান্নামের বিবিধ আযাব ও বাঁচার জন্য জাহান্নামিদের আর্তচিৎকার (শেষ পর্ব)
এস এম জাকারিয়া, মীরসরাই, চট্টগ্রাম ।
খ) জাহান্নাম বাসীর আর্তচিৎকার -
জাহান্নামিরা এমন সব বিচিত্র ও কঠিনতর শাস্তির প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে আর্তচিৎকার দিয়ে যা বলবে -
১| সূরা যুখরুফের ৭৪-৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলছেন :
" اِنَّ الۡمُجۡرِمِیۡنَ فِیۡ عَذَابِ جَهَنَّمَ خٰلِدُوۡنَ. ا یُفَتَّرُ عَنۡهُمۡ وَ هُمۡ فِیۡهِ مُبۡلِسُوۡنَ ".
অর্থাৎ : " নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ওদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং ওরা তাতে (শাস্তি ভোগ করতে করতে) হতাশ হয়ে পড়বে "। (১)
২| সূরা যুখরুফের ৭৭-৭৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলছেন :
" وَ نَادَوۡا یٰمٰلِكُ لِیَقۡضِ عَلَیۡنَا رَبُّكَ ؕ قَالَ اِنَّكُمۡ مّٰكِثُوۡنَ. لَقَدۡ جِئۡنٰكُمۡ بِالۡحَقِّ وَ لٰكِنَّ اَكۡثَرَكُمۡ لِلۡحَقِّ كٰرِهُوۡنَ ".
অর্থাৎ : " ওরা চিৎকার করে বলবে, ‘হে মালেক (দোযখের অধিকর্তা)! (২) তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন।’(৩) সে বলবে, ‘তোমরা তো (চিরকাল) অবস্থান করবে।’(৪) (আল্লাহ বলবেন,) আমি তো তোমাদের নিকট সত্য পৌঁছে দিয়েছিলাম; কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই তো সত্যবিমুখ ছিলে।(৫)
৩| সূরা ফাতিরের ৩৭ নং আয়াতে তাদের আবেদন এবং আল্লাহ তায়া’লার জবাব :
" وَ هُمۡ یَصۡطَرِخُوۡنَ فِیۡهَا ۚ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا غَیۡرَ الَّذِیۡ كُنَّا نَعۡمَلُ ؕ اَوَ لَمۡ نُعَمِّرۡكُمۡ مَّا یَتَذَكَّرُ فِیۡهِ مَنۡ تَذَكَّرَ وَ جَآءَكُمُ النَّذِیۡرُ ؕ فَذُوۡقُوۡا فَمَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ ".
অর্থাৎ : " আর সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করুন, আমরা যা করতাম তার পরিবর্তে সৎকাজ করব। আল্লাহ্ বলবেন, আমরা কি তোমাদেরকে এতো দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ উপদেশ গ্ৰহণ করতে চাইলে উপদেশ গ্ৰহণ করতে পারতো?(৬) আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল।(৭) কাজেই তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর; আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই "।
৪| সূরা হা-মীম-আস্ সিজদাহের ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলছেন :
" وَ قَالَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا رَبَّنَاۤ اَرِنَا الَّذَیۡنِ اَضَلّٰنَا مِنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ نَجۡعَلۡهُمَا تَحۡتَ اَقۡدَامِنَا لِیَكُوۡنَا مِنَ الۡاَسۡفَلِیۡنَ ".
অর্থাৎ : " সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীরা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! যে সব জ্বিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদেরকে দেখিয়ে দাও, (৮) আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে ওরা লাঞ্ছিত হয়।’ (৯)
➤➤ ব্যাখ্যা :
১) মুক্তি পাওয়া থেকে হতাশ ও নিরাশ হবে।
২) জাহান্নামের দারোগার নাম।
৩)অর্থাৎ, আমাদেরকে মৃত্যু দান করুন, যাতে আযাব থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাই।
৪) অর্থাৎ, সেখানে মৃত্যু আবার কোথায়? শাস্তির এই জীবন মৃত্যু অপেক্ষা আরো নিকৃষ্টতর হবে। আর এ ছাড়া তো অন্য কোন উপায়ও থাকবে না।
৫) এটা আল্লাহ তাআলার উক্তি অথবা ফিরিশতাগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে বলবেন। যেমন কোন বড় অফিসার প্রশাসন বা সরকারের তরফ থেকে ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করে। এখানে أكثر (অধিকাংশ) অর্থ সবাই। অর্থাৎ, সমস্ত জাহান্নামী। অথবা أكثر বলতে নেতা ও সর্দারদেরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য জাহান্নামীরা তাদের অনুসারী হওয়ার দরুন তাদের মধ্যেই শামিল থাকবে। حَقّ (সত্য) বলতে সেই দ্বীন ও পয়গাম, যা পয়গম্বরগণের মাধ্যমে মানুষের মাঝে পাঠিয়েছেন। আর সর্বশেষ حق (সত্য) হল কুরআন ও ইসলাম।
৬) অর্থাৎ জাহান্নামে যখন কাফেররা ফরিয়াদ করবে যে, হে আমাদের পালনকর্তা; আমাদেরকে এ আযাব থেকে মুক্ত করুন, আমরা সৎকর্ম করব এবং অতীত কুকর্ম ছেড়ে দেব, তখন জওয়াব দেয়া হবে যে, আমি কি তোমাদেরকে এমন বয়স দেইনি। যাতে চিন্তাশীল ব্যক্তি চিন্তা করে বিশুদ্ধ পথে আসতে পারে?
হযরত আলী ইবন হুসাইন যায়নুল আবেদীন রহঃ বলেন, এর অর্থ সতের বছর বয়স। কাতাদাহ আঠার বছর বয়স বলেছেন। (ইবন কাসীর) এতে সতের বা আঠারোর পার্থক্য সম্ভবত এই যে, কেউ সতের বছরে এবং কেউ আঠারো বছরে সাবালক হতে পারে। শরীআতে এ বয়সটি প্রথম সীমা, যাতে প্রবেশ করার পর মানুষকে নিজের ভাল-মন্দ বোঝার জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা হয়। এ বয়সে মানুষ সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের মধ্যে ফারাক করতে চাইলে করতে পারে এবং গোমরাহী ত্যাগ করে হিদায়াতের পথে পাড়ি দিতে চাইলেও দিতে পারে। যে ব্যক্তি সুদীর্ঘকাল বেঁচে থাকার পরও সতর্ক হয়নি এবং প্রকৃতির প্রমাণাদি দেখে ও নবী-রাসূলগণের কথাবার্তা শুনে সত্যের পরিচয় গ্রহণ করেনি সে অধিক ধিক্কারযোগ্য হবে। ( ইবন কাসীর, বাগভী)
একথাটিই হাদীসে এসেছে এভাবে, “যে ব্যক্তি কম বয়স পাবে তার জন্য তো ওজরের সুযোগ থাকে কিন্তু ৬০ বছর এবং এর বেশী বয়সের অধিকারীদের জন্য কোন ওযর নেই।” (সহীহ বুখারী)
হযরত আলী রাঃ বলেন, আল্লাহ যে বয়সে গোনাহগার বান্দাদেরকে লজ্জা দেন, তা হচ্ছে ষাট বছর। ইবনে আব্বাসও এক বর্ণনায় চল্লিশ, আর অন্য বর্ণনায় ষাট বছর বলেছেন। এ বয়সে মানুষের উপর আল্লাহর প্রমাণ পূর্ণ হয়ে যায় এবং মানুষের জন্যে কোন ওযর আপত্তি পেশ করার অবকাশ থাকে না। কারণ, ষাট বছর এমন সুদীর্ঘ বয়স যে, এতেও কেউ সত্যের পরিচয় লাভ না করলে তার ওযর আপত্তি করার কোন অবকাশ থাকে না। এ কারণেই উম্মতে মুহাম্মদীর বয়সের গড় ষাট থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। (ইবনে মাজহ)
৭| এ সতর্ককারী সম্পর্কে কয়েকটি মত আছে। কারও কারও মতে, চুল শুভ্র হওয়া। বার্ধক্যের নিদর্শন প্রকাশ পাওয়া। আবার কারও কারও মতে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (ইবন কাসীর) আবার কারও নিকট, কুরআনুল কারীম। কেউ কেউ বলেছেন, জ্বর-ব্যাধি। (ফাতহুল কাদীর)
অর্থাৎ, স্মরণ করিয়ে দেওয়া ও উপদেশ দেওয়ার জন্য পয়গম্বর (সাঃ) এবং তাঁর মিম্বর ও মেহরাবের উত্তরাধিকারী (নায়েব) আলেমগণ ও দ্বীনী দাওয়াত দাতাগণ তোমাদের নিকট এসেছিল, কিন্তু তোমরা না আপন জ্ঞান দ্বারা কাজ নিয়েছিলে, আর না সত্যের আহবানকারীদের কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেছিলে।
৮) এর অর্থ পরিষ্কার যে, ভ্রষ্টকারী কেবল শয়তানরাই হয় না, বরং অনেক সংখ্যক মানুষও শয়তানের প্রভাবে লোকদেরকে ভ্রষ্ট করার কাজে ব্যস্ত থাকে। পক্ষান্তরে কেউ কেউ জ্বিন বলতে ইবলীস এবং ইনসান বলতে ক্বাবীলকে বুঝিয়েছেন; যে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম নিজের ভাই হাবীলকে হত্যা করে যুলুম এবং মহাপাপ সম্পাদন করে। হাদীস অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত অন্যায়ভাবে সংঘটিত সমস্ত হত্যার পাপের একটি অংশ তার ঘাড়ে চাপবে। কারণ সেই হল মানুষের ইতিহাসে হত্যা-অপরাধের পথিকৃৎ। আমাদের মতে প্রথম অর্থই সর্বাধিক সঠিক।
৯) অর্থাৎ, আমাদের পা দিয়ে তাদেরকে পদদলিত করে খুব লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করি। জাহান্নামীদের অনুসৃত নেতাদের উপর যে রাগ হবে তা মিটানোর জন্য তারা এ কথা বলবে। অথচ তারা সকলেই অপরাধী এবং সকলেই এক সাথে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।যেমন মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন -
" لِكُلِّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لاَ تَعْلَمُوْنَ "
অর্থাৎ, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ (শাস্তি) রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না। (আ’রাফঃ ৩৮)
এভাবে বিভিন্ন জায়গায় জাহান্নামীদের কথা আলোচনা করার পর মহান আল্লাহ তায়া’লা ঈমানদার জান্নাতীদের কথা আলোচনা করছেন। আর এটাই হলো সাধারণতঃ কুরআনের বাক্য বিন্যাস পদ্ধতি। যাতে ভয়ের সাথে আশা এবং আশার সাথে ভয়ের কথা উল্লেখ করার প্রতিও যত্ন নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ভীতি প্রদর্শনের পর এবার সুসংবাদ দেওয়া হচ্ছে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার শাকেরীন বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ও জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচানোর মতো সকল প্রকারের আমল করার তাওফিক দান করো।
( সংকলক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী )
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com