প্রমথ চৌধুরী ‘বইপড়া’ প্রবন্ধে বলেছিলেন “বই গড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। প্রথমত্র, সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না, কেননা আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই। দ্বিতীয়ত, অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবে। তিনি আরও বলেছিলেন, রাগে-শোকে, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবন ধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সেই জীবনকেই সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমণ্ড ঠেকবে।’ বইপড়া এবং পাঠাগার নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময় প্রমথ চৌধুরীর কথাগুলোর বাস্তবতা আয়নার মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ পাঠমুখী নয়,
তারা এ সৌখিন অভ্যাসটাকে ধারণ করতে পারেনি।
ফলে বছর পরম্পরায় আমাদের দেশের নাগরিকদের বিরাট একটি অংশ বেড়ে উঠেছে গড়া-বিমুখ প্রজন্ম হয়ে। আমি শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাঠাগার কার্যক্রম পরিচালনা করি।
বই পাঠ এবং পাঠাগার কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরাই আমার মূল চালিকা শক্তি। একজন শিক্ষার্থীকে বই এবং পাঠাগারমুখী করে তোলা আমার মূল উদ্দেশ্য। এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতায় যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছি, তার সারমর্ম হলো: য্যদেরকে আমি নাই এবং পাঠাগারমুখী করেছি, তাদের অধিকাংশ আগে কখনো পাঠ্যবই ছাড়া ভিন্ন কোনো বইয়ের সান্নিধ্য পায়নি পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অনান্য বই যে কতো গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কেও তারা আগে কখনো ধারণা পায়নি। তাদের পরিবারের অভিভাবকরা তাদেরকে শুধু পাঠ্যবই পড়ার প্রতি তাগাদা দিয়েছেন একটি ভালো রেজাল্ট করার আশায়। তারা যে প্রান্তিক জনপদে বসবাস করেন, সেখানে পাঠাবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের সান্নিধ্য পাওয়া তাদের জন্য অ’লক্ষীক স্বপ্নের মতো। তাদের কাছে যখন একগুচ্ছ বই নিয়ে যাই, তারা বইগুলো পেয়ে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। খুশির বার্তা হলো, প্রান্তিক জনগদের তরুনদের হাতে বই তুলে দেওয়ার পর তাদের অধিকাংশ বইপাঠে মনোযোগী হয়ে উঠছে।
আবার বিপরীতে যে বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম তা হলো অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে খুব বেশি আগ্রহি নয়। তারা অবসর সময়টি হেলায়-হেলায় কাটাতে চায়। তারা শুধুমাত্র পাশের আশায় পাঠ্যবইগুলো পড়ে। এসব শিক্ষার্থীদের কাছে যখন বই নিয়ে যাই, বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি, তখন তাদের অনাগ্রহ দেখে মনে হয়, যেনো ‘অঙ্গের দেশে আয়না বিক্রি করতে এসেছি” তখন প্রমথ চৌধুরীর বইপড়া প্রবন্ধের লাইনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তিনি বলেছিলেন ‘বইগড়াকে অনেকে কুপরামর্শ মনে করেন’ দুই, পাঠাভ্যাস ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। এটি অনেক সময় অন্যের দেখা থেকে আগ্রহ জন্মায়। যেমন- একটি পরিবারের বাবা-মা যদি নিয়মিত বই পড়েন, তাহলে সেই পরিবারের সন্তানেরাও পাঠমুখী হয়ে ওঠে। কারণ পরিবারের বাবা মায়ের দেখা নিত্য কাজটি সন্তানের জন্য একটি অনুকরণীয় অভ্যাস হয়ে ওঠে। প্রতিদিন বাবা মা সন্তানকে সাথে নিয়ে যদি বইপাঠে কিছুক্ষন সময় দেন, তাহলে এই চর্চাবোধ থেকে একসময় সন্তানটি ধীরে ধীরে বইমুখী হয়ে ওঠবে। এটি শিশুকাল থেকে সন্তানকে বইমুখী করার পারিবারিক অনুশীলনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ।
প্রতিটি পরিবার থেকে এমন অনুশীলনের সূচনা করতে পারলে প্রতিটি পরিবার থেকে সৃষ্টি হবে একেক জন পাঠক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বাড়িতে কিংবা পার্কে অবসর সময় কাটানোর জন্য আমরা সন্তান কিংবা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের হাতে একটি মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছি এবং এই মোবাইল ফোনে আমরা এতই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, যেনো এটি ছাড়া আমাদের একটি সেকেন্ডও চলেনা। একটি মোবাইল ফোন যেন সময় কাটানোর একটি অপরিহার্য মাধ্যম। আমাদের জীবনে অপরিহার্য মাধ্যম কিন্তু একটি মোবাইল ফোন নয়। আমাদের জীবনের অপরিহার্য মাধ্যম হলো বই পাঠ চক্র। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা, আমরা সন্তানকে মোবাইল ফোনের পরিবর্তে একটি বই হাতে তুলে দিতে পারিনি। শিশুকাল থেকে তাদেরকে বইমুখী করে তুলতে পারিনি। এটা না হওয়ার একটি মাত্র কারন, তাহলো: পরিবারের সদস্য এবং বাবা মায়েরা বই পাঠমুখী না হওয়া, বই পাঠের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া। একটি পরিবারের বাবা মায়েরা সন্তানের জন্য যদি অনুকরণীয় হয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে সে পরিবারের সন্তানেরাও সহসা অনুকরণীয় হয়ে গড়ে ওঠে না। বাস্তবতা হলো, সন্তানকে বইমুখী করার আগে বাবা ও মায়ের মাঝেও বইমুখী হতে হবে। তাহলে তাদের সন্তানেরাও একসময় বইমুখী হবে।
আমি “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র” নামের বাংলাদেশে একটি~~~~~~~~ গ্রুপের সদস্য। এ গ্রুপের সদস্যরা সবাই বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। তারা বইপাঠ নিয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে বিভিন্ন সময় পোস্ট করেন। তাদের পোস্টগুলো দেখে মানে হয়, তাদের গাড়িগুলো যেনো একেকটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। তারা বাংলাদেশের সকল জেলা উপজেলা শহর গুলাতে ছোটো-বড়ো সবাইকে নিয়ে একসাথে বই পড়ানোর কায্যকম করে আসছে বই পড়েন, গল্প করেন, আড্ডায় মেতে ওঠেন। তাদের ‘গাড়ির মধ্যেই রিডিং রুম’ এ গুলো একেকটি গারিবারিক পাঠাগারের মতো। সেখানে তারা ছোটো-বড়ো সকই মিলে বই পড়তে পারেন৷ তাদের পরিবারে বড়োদের বইপড়া দেখে ছোটোরাও বইমুখী হয়ে ওঠে। তারা শিশুকাল থেকে সন্তানদেরকে বইমুখী করে তোলেন। এটি তাদের সন্তানের জন্য পারিবারিক শিক্ষার অনুশীলনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রতিটি বাবা-মা তার সন্তানের সুন্দর-ভবিষৎ কামনা করেন। তাদের স্বপ্ন থাকে: সন্তানটি যেনো মানুষের মতো মানুষ হয়, তার ভবিষ্যৎ জীবন যেনো ফুলের মতো সুন্দর হয়। কোনো বাবা মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। কিন্তু প্রত্যেক বাবা-মায়ের সে স্বপ্ন পূরণ হয় না। তাদের সে প্রত্যাশা কখনো কখনো ‘আশার গুড়ে বালি’ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানটি যখন কোনো এক সময় বিপদগামী হয়ে ওঠে, তখনই বাবা মায়ের সব স্বপ্ন ধূলোয় মিশে যায়। সন্তানকে আদর্শবান সন্ধান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কতগুলো পালনীয় এবং অভ্যাসগত বিষয় আছে। তৎমধ্যে নৈতিক আদর্শ মেনে চলা, ভালো মানুষের সাথে বেড়ে ওঠা এবং ভালো বইপড়া আবশ্যক। এখন সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করলে অবশ্যই প্রতিটি বাবা মায়ের দায়িত্ব হলো, সবার আগে সন্তানকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
পবিত্র কুরআনের প্রথম শব্দ ‘ইকুরা’ জিবরীল আলাইহিসসালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলে আরাবির নিকট সর্বপ্রথম এই শব্দ সন্তুলিত আয়াতটি নিয়ে ‘ধারে হেরা’য় আগমন করেন। ‘ইকুরা’ আরবি শব্দঃ এর অর্থঃ পড়ুন। পুরো আয়াত “ইকুরা বিসমি রাক্সিকাল্লাজি খালাক” অনুবাদ হচ্ছে। পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায়। পড়া কতো যে গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আমাদের বুঝতে হবে পাঠের কোনো বিকল্প নেই। ‘ইকরা’ শব্দ দিয়ে শুরু করা দ্বারা সহজেই প্রতিয়মান হয়। মানবজীবনে পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে এখন নৈতিক অবক্ষয়ের জয়জয়কার। চারদিকে শুধু নৈতিক অবক্ষয়ের পদধ্বনি।
পাড়ায় মহল্লায়, নগরে একই অবস্থা। সবার মুখে একই সুর, নৈতিকতা হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুন প্রজন্ম চরম নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। এর একমাত্র কারণ, তা হলো। তারা মানবিক চর্চাকেষ থেকে বঞ্চিত। নৈতিক পাঠ থেকে বঞ্চিত। তারা ভালো মননশীল মানুষের সাথে গড়ে ওঠতে পারেনি। তারা অবক্ষয়কে জীবনের উপভোগ মনে করেছে। যার দরুন। অবক্ষয়ের কালো মেঘ খুব কম সময়ে তাদের ভবিষ্যতের আলোকিত জীবনকে অন্ধকারের কালো চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু একটি ভালো বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত করে। আলোর পথে আসতে আহ্বান করে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো আমরা নতুন প্রজ্জম’কে সে পথে আহ্বান করিনি। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। পাঠাগার হলো মানবিক, নৈতিক ও বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরির কারখানা। পৃথিবীর বিখ্যাত মনীষীরা পাঠাগারকে জীবন-জয়ের মাধ্যম হিসেবে বেচে নিয়েছিলেন। পাঠাগারের সান্নিধ্যে আসার কারণে তারা মনীষী হতে পেরেছেন, সভা হয়ে জীবন ধারণ করতে পেরেছেন। ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন। আমাদের অনুধাবন করা উচিৎ, যে যতো বেশি পড়ে, সে ততোবেশি সভ্য হয়ে বেড়ে ওঠো। পৃথিবীর বিখ্যাত মনীযারা তার বিরল উদাহরণ।
এখন পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সবার আগে পাঠ কার্যক্রমের সূচনা করতে হবে। পরিবারের বাবা মায়েরা নিজেরা বই পাঠমুখী হয়ে আপন সন্তানদেরকে পাঠমুখী করে গড়ে তুলতে পারে। এটা পারিবারিক অনুপ্রেরণা। একটি সমাজে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের মানুষকে বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করে তোলা যায়। একটি পাঠামার একটি জনপদের আলোকবর্তিকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরি সম্পর্কে বলেছিলেন। “অতল স্পর্শ কালসমূদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সংকো বাঁধিয়া দিবে। লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে- দিকে ধাবমান হও, কোষাও বাধা পাইবে না।” সমাজকে আলোকিত করার মানসে, সমাজের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা উঠতি বয়সী শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদেরকে বইমুখী করে তোলার আন্দোলনকে বেগবান করতে পারি। তাদেরকে বইমুখী করে গড়ে তুলতে পারি। বইয়ের সাথে সেতু বন্ধন তৈরি করে দিতে পারি। সবচেয়ে সুন্দর উপমা হতে পারে, যদি নিজের পরিবার থেকে বইপড়া আন্দোলনের সূচনা করতে পারি, তাহলে আমরা সফনল হব। একদিন সে আন্দোলন পাড়া-মহল্লা ছড়িয়ে সমাজের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।