1. admin@ichchashakti.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০২ অপরাহ্ন

বাবা হত্যার প্রতিশোধ — জাকির আলম 

  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১৭ বার পঠিত

বাবা হত্যার প্রতিশোধ

জাকির আলম 

 

গ্রামের নাম আদিনাথপুর। এই গ্রামের চারপাশের রূপ বৈচিত্র্য অত্যন্ত মনোরম। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী। নদীর দুই পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি স্থাপনা। অধিকাংশ পরিবার কৃষি নির্ভর। এখানকার পলি বেষ্টিত মাটি উর্বর হওয়ায় ফসলাদির দিক থেকে গ্রামটি বেশ উন্নত। সবাই মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। কারো সাথে কারো তেমন কোনো হিংসা বা দ্বন্দ্ব নেই। এই গ্রামের মধ্যেই প্রাইমারি স্কুল এবং মাধ্যমিক স্কুল অবস্থিত। সেজন্য শিক্ষা-দীক্ষার দিক থেকেও ছেলে-মেয়েরা অনেকটাই উন্নত পর্যায়ে রয়েছে। অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই গ্রামেই হিমেলদের বসবাস। হিমেলের বাবা জমির কৃষক। জমি আবাদ করে যে ফসল পায় তাই দিয়েই কোনো রকম সংসাদ চলে। নিজস্ব জমি তেমন না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করে হিমেলের বাবা। হিমেলের বাবা আকবর আলী সারাদিন আবাদি জমিতে কাজে ব্যস্ত থাকে। বিশ্রাম শুধু খাওয়ার সময় এবং রাতে। তাছাড়া সবসময় কাজের মধ্যেই থাকে আকবর আলী। তিনি অনেকটা ভদ্র প্রকৃতির একজন মানুষ। একদম সাদাসিধে। কোনো প্রকার লোভ লালসা তার মধ্যে নেই। জমি আবাদ করে যে ফসল পান তা দিয়েই তিনি তার সংসার নির্বাহ করে থাকেন।

 

নিজের যা আছে তাই নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট আছেন। হিমেল তখন সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে। পড়ালেখায় অনেক ভালো। হিমেল প্রতিবার ক্লাসে প্রথম হয়ে পাস করে এসেছে। সেজন্য হিমেলের বাবা-মার স্বপ্ন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে হিমেল একদিন অনেক বড় হবে। সরকারি কোনো বড় চাকরি নিয়ে বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাবে। সেই পথেই হাঁটছে হিমেল। হিমেলও অনেক সভ্য এবং ভদ্র প্রকৃতির একটা ছেলে। সবসময় বাবা-মার কথা মতো চলে। কখনো কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত হয় না। সময় পেলেই জমিতে বাবার কাজে সহযোগিতা করে। বাকি সময় স্কুল এবং পড়ালেখা করেই কাটে হিমেলের। এভাবেই চলতে থাকে হিমেলদের দিন কাল। হিমেলের বাবা জমিতে যে ধান লাগিয়েছে ইতোমধ্যেই সে ধান পাকতে শুরু করেছে। এবার পাকা ধান ঘরে তোলার পালা। মুখে হাসি নিয়েই আকবর আলী একাই জমির পাকা ধান কাটতে যায়। আকবর আলী জমির সোনালি পাকা ধান ভাওয়াইয়া গানের সুরে হাসি মুখে কাটতে থাকে।

 

পাশেই এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জমি।  তারাও ধান কাটতে এসেছে। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আকবর আলীর জমির ধান বেশি কাটলে সেটা সহ্য করতে পারেন না। সহ্য না করারই কথা। কেউই সেটা সহ্য করবে না। কিন্তু আকবর আলী একা প্রতিবাদ করতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষ আকবর আলীকে মারার জন্য তেড়ে আসে। সেখানে আকবর আলী একা থাকায় তাদের সাথে পেরে উঠে না। এমতাবস্থায় প্রতিপক্ষের এলোপাতাড়ি কিল-ঘুসি এবং মার খেয়ে ঘটনাস্থলেই আকবর আলী আহত হয়ে জ্ঞান হারান। বাড়িতে জানাজানি হলে হসপিটালে নেওয়ার সময় আকবর আলী মৃত্যু বরণ করেন। তখন আকবর আলীর পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। অথচ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা হিমেলদের নেই। থানায় মামলা করতে চাইলেও প্রতিপক্ষের ক্ষমতার জোরে তা ঢাকা পড়ে যায়। টাকা এবং ক্ষমতার জোরে ইতোমধ্যেই প্রতিপক্ষ সব দালালদের কিনে নিয়েছে। তাই কিছুই করার থাকে না হিমেলদের।

 

মুখ বুঁজেই সবকিছু সহ্য করতে হয়। এ ছাড়া যে আর কোনো পথ নেই। আকবর আলীর মৃত্যুতে সংসারে তুমুল অভাব নেমে আসে। এর বেশি প্রভাব পড়ে হিমেলের উপর। বিশেষ করে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হিমেলের অনেক কষ্ট হয়। এক পর্যায়ে হিমেল পড়ালেখা ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু মায়ের আদেশ লেখাপড়া করে বড় আইনজীবী হতে হবে। এর জন্য হিমেলের মা যতো কষ্ট করতে হয় করবে। তবুও হিমেলকে বড় আইনজীবী হয়ে এই খুনের বদলা নিতে হবে।

 

সেই মোতাবেক হিমেলও শপথ নেয় বাবার খুনের বদলা নিবেই নিবে। লেখাপড়া করে বড় আইনজীবী হয়ে তার বাবা হত্যার খুনিদের ফাঁসির কাষ্ঠ ঝুলিয়েই ছাড়বে। সেই অঙ্গীকার বুকে ধারণ করে হিমেল তুমুল বেগে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকে। তার স্বপ্ন একটাই বাবা হত্যার বিচার হিমেল নিজ হাতে করবে। এভাবেই চলতে থাকে দীর্ঘ সময়। একের পর এক হিমেল ক্লাসে প্রথম হয়ে পাস করতে থাকে। এসে যায় তার কাঙ্খিত সময়। তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। খুব শীঘ্রই সে বড় আইনজীবী হতে চলেছে।

 

এই আইনজীবী হতে তাকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়। বিশেষ করে হিমেলের মায়ের অবদান অনেক বেশি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিনি  হিমেলকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মায়ের স্বপ্ন পূরণে দিন-রাত অত্যধিক পরিশ্রম করে হিমেল হতে চলেছে বড় আইনজীবী। শেষমেষ সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় হিমেল। পুরো গল্প সিনেমাটিক কাহিনির মতো মনে হলে ঘটতে চলেছে বাস্তব ঘটনা। হতে পারে তার থেকেও বেশি কিছু। এবার এক এক করে ধরে আইনের আশ্রয় নিয়ে বাবার খুনিদের বিচার করার  পালা। সেই জন্য চিহ্নিত খুনিদের বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এমতাবস্থায় কিছুদিনের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামীকে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়। আসামীরা ভেবেছিলো সত্যি সত্যি তারা পার পেয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও তারা নীরব ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করতো তারা। কোনো প্রকার ভয় ছিলো না তাদের মনে। কিন্তু খুব সহজে তারা পার পেতে পারেনি। এবার তারা বিচারের মুখোমুখি হতে চলেছে। মনের মধ্যে ফাঁসির ভয় এসেছে। আসামীরা ভুলেও ভাবেনি একদিন তাদের বিচারের কাঠগড়ায় খুনের আসামী হয়ে দাঁড়াতে হবে। তারা বুঝতে পারেনি হিমেল এতো বড় আইনজীবী হয়ে তাদের শাস্তির মুখোমুখি করবে। এবার যে তাদের ছাড় নেই।

 

হিমেল এবং তার মায়ের একটাই স্বপ্ন খুনের বদলে খুন। খুনিরা জানতে পারবে অন্যায় করলে তার সাজা ভোগ করতেই হয়। এতোকাল আসামীরা মুক্ত ভাবে চলাফেরা করলেও আজ শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়েছে আইনের হাতে। হিমেলের শক্তি এবং ক্ষমতার কাছে আসামী পক্ষের সব শক্তি ম্লান হয়েছে। এবার তাদের কঠিন সোজা হতে চলেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো প্রকার সুযোগ নেই। আইনের রশি এবার তাদের শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। সেই ভয়ে আসামীরা ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু অথবা যাবৎ জীবন কারাদণ্ডের ভয়ে জড়সড় হতে চলেছে। অবশেষে এসেই গেলো সেই কাঙ্খিত দিন। বিচারের দিন ধার্য হলো। হিমেল তার মা এবং আত্মীয় পরিজন নিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে হাজির হলো। আসামীদের কারাগার থেকে সতর্কতার সাথে আদালতে নিয়ে আসা হলো। তোলা হলো অপরাধের কাঠগড়ায়। মনের মধ্যে কতো না ভয় কাজ করছে তাদের ! অথচ আজ তাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। অপরাধ করলে একদিন না একদিন সাজা ভোগ করতেই হয়। একবার কেউ বড় অপরাধ করে আইনের হাতে পড়লে সেখান থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আইনের হাত অনেক লম্বা। জর্জ সাহেব বিচারকের আসনে বসে আছেন। শুরু হলো সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ।

 

হিমেল আগে থেকেই বাবা হত্যার তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে রেখেছিলো। সেই মোতাবেক উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ নিয়ে হিমেল আদালত চত্বরে হাজির হয়েছে। সকল সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে মহামান্য আদালত আসামীদের দোষী বলে সাব্যস্ত করেন এবং যথাযোগ্য শাস্তি প্রদান করেন। খুনের আসামী মোট পাঁচজন। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষকে ফাঁসির আদেশ এবং বাকি দু’জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বিচারের রায় শুনেই আসামীরা সহ তাদের পরিবারের লোকজন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কিন্তু তাদের সেই কান্না উপস্থিত কারো মনে কোনো দয়ার সঞ্চার করেনি। যাবৎ জীবন প্রাপ্ত  দু’জনের মধ্যে একজন মহিলা ছিলো।  বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এমনিতেই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তার উপর আবার যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ। বারংবার মহামান্য আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েও ক্ষমা পাননি কোনো আসামী। বরং হিমেল, তার মা এবং আত্মীয় পরিজনের মনে আদালতের রায় শুনে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর আনন্দের হাসি হাসতে থাকে। অপর দিকে আসামী পক্ষের কান্নায় ভেসে যায় আদালত প্রাঙ্গন।

 

কিছু সময় পর পুলিশ আসামীদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে নিয়ে চলে। তখন আসামী পক্ষের কান্না আরও বাড়তে থাকে। এই সত্য ঘটনা যেন কোনো সিনেমাকেও হার মানাবে। সত্যিই এটি অনেক বিরল একটি ঘটনা। হিমেল পেরেছে তার বাবা হত্যার খুনিদের আইনের মুখোমুখি করে বিচারের সাজা ভোগ করতে। কিন্তু এই খুনের আসামীদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে হিমেলকে পাহাড়সম বেগ পোহাতে হয়েছে। তবেই না পেরেছে বাবার খুনিদের বিচার করতে। এখন আর কোনো ক্ষভ নেই হিমেলদের। তখন হিমেল এবং মা সহ তার আত্মীয় পরিজনদের সাথে নিয়ে হাসি মুখে আদালত প্রাঙ্গন থেকে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে। আসামী চলে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে। এখন তাদের মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে হবে। উপর মহলের আদেশ পেলেই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে মরতে হবে জল্লাদের হাতে। করুণ মৃত্যুর শঙ্কায় অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা। অপর দিকে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা বন্দি কারাগারে বাকি জীবন কাটাতে পুলিশের জিম্বায় চলে গেলো।

Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ ইচ্ছাশক্তি
Theme Customized By Shakil IT Park