1. admin@ichchashakti.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ অপরাহ্ন

ভালোবাসার সমীকরণ — জাকির আলম  

  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৩৪ বার পঠিত

ভালোবাসার সমীকরণ (পর্ব : ১৪)

জাকির আলম  

 

এখন পৌষ মাস। দিন দিন শীতের প্রকোপ বাড়ছে। ভোর হতেই হালকা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। বিন্দু বিন্দু শিশির কণায় ভিজে যাচ্ছে ক্ষেতের সবুজ ঘাস। সন্ধ্যা হতেই গায়ে জড়াতে হয় শীতের পোশাক। এমন দিনে ঠাণ্ডা জনিত রোগে অনেকেই ভুগছে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক রোগ বালাই ক্রমশ বেড়ে চলছে। অথচ একটু সচেতন হলেই বিভিন্ন রোগের হাত থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি। হতে পারে এই রোগের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী৷ এর মাঝে বেশ কয়কদিন ধরে মোনা খুব অসুস্থ।

 

স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছ থেকে নেওয়া ওষুধে কোনো কাজ করছে না৷ সেজন্য শহরের বড় হসপিটালে নেওয়া হলো মোনাকে৷ এখান থেকে মোনার বাবা নিজেই মোনাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। ওদিকে মোনার অসুখের কথা শুনতেই মাঈনুল ছুটে এলো মোনার কাছে। সবাই বড় ডাক্তার আসার অপেক্ষায়। এক সময় অপেক্ষার অবসান হলো। ডাক্তার চলে এলো৷ শুরু হলো মোনার চিকিৎসা। ডাক্তার সাহেব দেখলেন মোনার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন। কয়েক দিন হসপিটালে থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। মাঈনুল ওষুধের জন্য ফার্মেসিতে গেলো। মোনা শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। মুখে কোনো কথা নেই। প্রচণ্ড জ্বরে কাতরাচ্ছে। পাশেই বসে আছে মোনার বাবা। মোনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

 

আদরের মেয়ের অসুখে খুব টেনশনে আছেন। এমতাবস্থায় মাঈনুল ওষুধ নিয়ে চলে এলো। কিছু হালকা নাস্তার পর মোনাকে ওষুধ খাওয়ানো হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ওষুধ খেয়েই মোনা আবার শুয়ে পড়লো। এই প্রথম তার প্রিয় মানুষ পাশে। অথচ কোনো কথা বলতে পারছে না। এমন সময় হয়তো শ্রাবণকেও খুব মিস করছে মোনা। ফোন বাসায় রেখে যাওয়ায় শ্রাবণকে অসুখের কথা জানানো সম্ভব হলো না। এদিকে শ্রাবণও ব্যস্ত তার নিজ কাজে। ব্যস্ততার কারণে মোনাকে ফোন দিতে ভুলে গেছে। এর ফাঁকে মোনা এতো অসুস্থ তার কিছুই জানে না শ্রাবণ। মোনার পাশে বসা মাঈনুলও প্রথম প্রথম মোনার সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। নীরব হয়ে বসে আছে। বাসায় গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ থাকায় মোনার বাবা সন্ধ্যার পরেই বাসায় চলে এলো মাঈনুলের কাঁধে মোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে। মাঈনুলও সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। এর মাঝে মোনা ঘুমিয়ে গেছে। প্রায় দু’ঘণ্টা পর মোনার ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠেই মোনা মাঈনুলকে দেখতে পেলো। লজ্জায় মুচকি একটা হাসি দিলো।

 

বিপরীতে মাঈনুলও মুচকি হাসি দিলো। কিন্তু কি বলে দু’জনে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। তার উপর আবার মোনা খুব অসুস্থ। এর মাঝে মোনার সেবা যত্নের কোনো কমতি নেই। একের পর এক মোনার সেবা যত্ন করেই যাচ্ছে। কিছু সময় পর পর নার্স এসে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে মোনার শারীরিক অবস্থা। রাত তখন বারোটা। মোনা জেগে আছে। জেগে আছে মাঈনুলও। প্রিয় মানুষ অসুস্থ থাকায় ঘুম পালিয়ে গেছে মাঈনুলের চোখ থেকে। এতো অসুস্থতার মাঝেও মোনা খুব খুশি প্রিয় মানুষ পাশে থাকায়। সব লজ্জার অবসান টেনে মাঈনুলের সাথে মোনা কথা বলতে শুরু করলো।

মোনা : কি অবস্থা আপনার ?

মাঈনুল : দেখতেই তো পারছেন আপনি অসুস্থ তাকায় আমার অবস্থা কেমন হতে পারে…

মোনা : বাসার সবাই কেমন আছেন ?

মাঈনুল : সবাই ভালো আমি বাদে…

মোনা : কেন আপনার আবার কি হলো ?

মাঈনুল : আমার প্রিয় মানুষটা হসপিটালের বেডে অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে এমন সময় আমি কেমনে ভালো থাকি !

মোনা : আপনি কি আমাকে অনেক ভালোবাসেন ?

মাঈনুল : পরিমাপ করতে পারবো না। তবে আপনি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় একজন মানুষ।

মোনা : শুনে খুশি হলাম…

মাঈনুল : আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে ?

মোনা : সময় হোক বলবোনি…

মাঈনুল : আপনার শরীর এখন কেমন ? জ্বর কি কমলো ?

মোনা : এখন একটু ভালো লাগছে। সেজন্য আপনার সাথে কথা বলতে পারছি। আপনি আমার খুব কাছাকাছি বসেন। মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে একটু হাত বুলিয়ে দেন।

মাঈনুল : আচ্ছা ঠিক আছে তাই দিচ্ছি। এবার কেমন লাগছে আপনার ?

মোনা : একটু আরাম লাগছে…

মাঈনুল : তাহলে কথা না বলে নীরব থাকেন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

মোনা : কথা না বললে তো আপনার একা মনে হবে। কথা বলতে আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না। আপনি পাশে থাকায় মানসিক দিক থেকে আমি খুব সুস্থ আছি। এমন সময় আমার পাশে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মাঈনুল : ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমার বউ অসুস্থ আর আমি পাশে থাকবো না তা কি করে হয় !

মোনা : হা হা হা। এখনো কিন্তু কবুল বলে আপনার বউ হইনি আমি।

মাঈনুল : তাতে কি একদিন তো হবেন…

মোনা : যেদিন কবুল বলবো সেদিন থেকে আপনার বউ হবো আমি।

মাঈনুল : কষ্ট পেলাম একটু…

মোনা : কেন কেন ?

মাঈনুল : না কিছু না…

মোনা : আসলে আমি এমনিই। মজা করতে ভালো লাগে। মনে কষ্ট নিয়েন না।

মাঈনুল : না ঠিক আছে।

মোনা : রাত তো অনেক হলো ঘুমাতে হবে না আপনার ?

মাঈনুল : না কোনো সমস্যা নেই। আপনার ঘুম আসলে ঘুমাতে পারেন। আমি আপনার পাশেই আছি…

মোনা : আমার শরীর আর কথা বলার সায় দিচ্ছে না৷ চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। একটু ঘুমাতে হবে৷

মাঈনুল : ঠিক আছে ঘুমান আপনি। আমি আপনার পাশে জেগে আছি।

মোনা : ঠিক আছে…

অতঃপর কিছু সময় পর মোনা ঘুমিয়ে গেলো। পাশে বসা মাঈনুল সেবা যত্ন করেই যাচ্ছে। কখনো মোনার কপালে জল পট্টি লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার কখনো বা গায়ের কাঁথা ঠিক করে দিচ্ছে। মনে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। বরং আপন মনে মোনার সেবা যত্ন করতে তৎপর। প্রিয় মানুষ অসুস্থ হলে সবারই খারাপ লাগে। মাঈনুলও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রিয় মানুষের অসুখে খুব কষ্ট পাচ্ছে মাঈনুল। এতো কষ্ট হয়তো আগে কখনো পায়নি সে। তবুও বুকে পাথর বেঁধে মোনার পাশে বসে আছে। মোনা ঘুমিয়ে আছে নির্বিঘ্নে।

 

হসপিটালে অন্য সব রোগীরা বিভিন্ন অসুখে বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কেউ বা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। অনেকেই স্বজন হারিয়ে গভীর ক্রন্দনে কান্নাকাটি করছে। ভারী হয়ে আসছে হসপিটালের পরিবেশ। এজজন সুস্থ মানুষ হসপিটালে গেলে মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষ বুঝি হসপিটালের বেডে শুয়েই দিন-রাত যাপন করছে। অনেকের অবস্থা খুব খারাপ। তাদের অবস্থা দেখে মাঈনুল খুব শঙ্কিত মোনাকে নিয়ে। ইতোমধ্যে মাঈনুল মোনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। মনে মনে খুব খুশি এমন একটা মানুষ জীবনে কাছে পাওয়ার জন্য। কিছু সময় কথা বলেই বুঝতে পেরেছে মোনা মেয়েটা অনেক ভালো। অনেক মিষ্ট ভাষায় কথা বলে। সদা হাস্যোজ্জ্বল৷ নীমিলিত কণ্ঠস্বর। সুন্দরের কোনো কমতি নেই। চিবুকের কালো তিলের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মোনার বাহ্যিক সৌন্দর্য। মনে মনে চাইছে এবার সুস্থ হলেই মোনাকে মাঈনুল বউ করে ঘরে তুলবে। এমন সব স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙে গেলো মোনার। জেগেই দেখে মাঈনুল সেভাবেই বসে আছে মোনার পাশে।

 

মোনার বাম হাতে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। অন্য হাত মাঈনুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো ধরার জন্য। কিছু সময় ইতস্তত থাকার পর শক্ত করে মাঈনুল মোনার হাত ধরলো। আঙুলগুলো নেড়ে দিলো। নখ বড় হয়েছে কাটতে হবে। বিয়ের পর এই নখগুলো মাঈনুলের কেটে দেওয়ার খুব ইচ্ছে। খুব বেশি যত্ন করবে মোনার।

মাঈনুল : আপনার হাত অনেক সুন্দর।

মোনা : না তেমন সুন্দর না তো…

মাঈনুল : আপনি মানুষটা ভীষণ মিশুক। সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।

মোনা : আমি খুব কথা বলি। বলতে পারেন বাচাল প্রকৃতির।

মাঈনুল : আপনার মতো এমন একটা মানুষ আমি সারা জীবন খুঁজেছি। কিন্তু এতো সহজে আপনাকে কাছে পাবো জানা ছিলো না। এজন্য আল্লাহ তায়ালাকে অনেক ধন্যবাদ…

মোনা : সারা জীবন অনেক ভালোবাসবেন তো আমাকে ?

মাঈনুল : সারা জীবন তোমাকে আমার মাথায় করে রাখবো। ওহহ সরি আপনাকে তুমি করে বলে ফেললাম…

মোনা : না না সরি বলতে হবে কেন ! এখন থেকে আমার সাথে তুমি করেই কথা বলবেন। খুশি হবো…

মাঈনুল : তা না হয় বললাম। কিন্তু তোমাকেও যে আমার সাথে তুমি করে কথা বলতে হবে…

মোনা : ওকে বলবোনি…

মাঈনুল : না এখন থেকেই বলতে হবে…

মোনা : আপনাকে এখন তুমি করে বলতে আমার খুব লজ্জা করছে। মুখে আসছে না তুমি শব্দটা….

মাঈনুল : না বললে আমিও কথা বলবো না…

মোনা : তুমি কিন্তু অনেকটা অভিমানী !

মাঈনুল : এইতো তুমি করে বলছো। লজ্জা ভেঙে গেছে ! কিন্তু আমাকে অভিমানী বললে কেন ?

মোনা : তা নয়তো কি !

মাঈনুল : আমার মাথা…

মোনা : একটু পানি দাও তো খুব পিপাসা পেয়েছে।

মাঈনুল : হুমমম দিচ্ছি। এই নাও পানি…

মোনা : ধর ক্লাসটা রেখে দাও… জানো এখন আমি অনেকটাই সুস্থ। ডাক্তার সাহেব খুব ভালো ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় আমি সুস্থ হতে যাচ্ছি। সেজন্য অনেক শুকরিয়া…

আর তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ এতো আন্তরিকতার সহিত আমাকে সেবা করার জন্য। আমার পাশে থাকার জন্য। অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য…

মাঈনুল : তোমাকেও অনেক ভালোবাসি মাই সুইটহার্ট !

মোনা : সারা জীবন এমনি করেই আমার পাশে থেকো সব সময়। নিজের মাঝে আগলে রেখো আমাকে…

মাঈনুল : তুমি যেভাবে বলবে সে ভাবেই আমি তোমাকে রাখবো। কখনোই তোমাকে কষ্ট দিবো না। অনেক বেশি ভালোবাসবো তোমাকে।

মোনা : হুমমম। সকাল হতে চললো। দু’দিন ধরে এখানে এসে খুব বোরিং হয়ে গেছি। বাসায় যাওয়ার জন্য মন ছটফট করছে। আব্বু এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তোমার সাথে ফোনে কথা হবে। এখন থেকে সবসময় তোমার সাথে কথা হবে। আমার সবকিছু এখন তোমাকে ঘিরে…

মাঈনুল : ঠিক আছে।

 

এমতাবস্থায় দু’জনে কথা বলতে বলতেই মোনার বাবা চলে এসেছে মোনাকে বাসায় নিয়ে যেতে। মোনা এখন অনেকটাই সুস্থ। ওষুধ যা আছে তা খেলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। মোনার বাবা হসপিটালের সব খরচ মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে মোনাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সাথে মাঈনুলকে ধন্যবাদ দিতেও ভুল করলো না এতো কষ্ট স্বীকার করার জন্য। মোনার বাবা মাঈনুলকে বাসায় যাওয়ার কথা বলে মোনাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। মাঈনুল রয়ে গেলো একা। মোনাকে ছাড়তে হয়তো মাঈনুলের অনেক কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু ছাড়তে তো হবেই। এখনো যে মোনাকে বিয়ে করে নিজের করে পায়নি। কিছুটা মন খারাপ করেই মোনাকে বিদায় জানালো। মোনার শরীরের যত্ন নিতে বললো। ঠিক মতো ওষুধ খাওয়ার কথা বললো। মোনাও মাথা নাড়িয়ে মাঈনুলের কথার জব দিলো। এই বলেই তারা স্থান ত্যাগ করলো। গাড়ি চললো মোনাদের বাসার দিকে। মাঈনুল চললো তাদের বাসার দিকে। মাঝখানে রয়ে গেলো মোনা এবং মাঈনুলের প্রথম ঘটে যাওয়া কিছু সুখকর স্মৃতি।

 

(চলবে…)

Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ ইচ্ছাশক্তি
Theme Customized By Shakil IT Park