রঙধনু বিকেলের স্বপ্ন।
রকিবুল ইসলাম
আজ ভোর হইতেই বর্ষা নামিয়াছে। ভারী বর্ষণ যাহারে বলিয়া থাকি তেমনটা নয় আর কি! কথার গৃহ হইতে অফিস দুই কিলো মিটারের মত দূরত্ব হইবে। একখানি ছাতা লইয়া বৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া কিছু দূর হাঁটিয়া তারপর একটা রিকশায় চাপিয়া সে আজ অফিসে আসিয়াছে। আকাশ অবশ্য রেইনকোট পরিয়া পায়ে হাঁটিয়াই অফিসে আসিয়াছে। আকাশের বাড়ি হইতে অফিসের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার হইবে। আকাশ দূর হইতে কথাকে দেখিয়াই কহিল: সু-প্রভাত বৃষ্টিস্নাত মহারাণী!
আহ্! এই প্রভাতের বৃষ্টি! আধ ভেজা শাড়িতে বর্ষা সিক্ত আপনি! বেশ ভালোই লাগিতেছে। আপনার গৃহ তো অফিসের সন্নিকটে তাই এমন কথা নি:সৃত হইতেছে মুখ হইতে: বলিল কথা। আমার মত দূর হইতে আসিলে বোঝা যাইত মহারাজের কি হাল! ঠিক আছে বাবা আমি পরাজয় বরণ করিলাম: আকাশের সরল সহজ স্বীকারোক্তি ও আত্মসমর্পণ। পরাজয় না মানিয়া কি উপায় আছে! আমি যে মহারাণী! আপনার মহারাণী: কথার অতি আত্মবিশ্বাসী উক্তি।
আকাশ: দুপুরের খাবার আনিয়াছো না কি?
কথা: জ্বী না মহারাজ! প্রাতঃ কাল হইতেই বর্ষা ও আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখিয়া কোন আহারের সংস্থান না করিয়াই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়া ছিলাম।
আকাশ: যাক! কোন ব্যাপার না। আমরা দুজনেই আজ আমাদের বাড়িতে যাইয়া দুপুরের খাবার খাইয়া আসিব।
কথা:না মশাই। আমি যাই আর আপনার পরিবার সংশ্লিষ্ট সকলে অস্বস্তিতে পড়িয়া যাক তা আমি চাহি না।
আকাশ:না না! সেটা হইবে কেন? তুমি আমার মা জননী কে তো দেখিয়াছ। তাহাকে দেখিলে কি মনে হয় উনি এহেন কর্মকান্ড সাধন করিবেন? তাহাকে দেখিয়া কভু কি মনে হয় যে উনি বিব্রত বোধ করিবার মানুষ?
কথা: না! ঠিক তাহা নয়। তবে, বিবাহের পূর্বে ঘনঘন বরের গৃহে গমন কনের পক্ষে অ-শোভনীয় বৈ কি!
আকাশ: চলো আজ তাহলে আমরা বাহিরে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়া খাইব। এতদিন তো দুজনের অভিসারের ক্ষণে পার্কে, ফুটপাতে, বিভিন্ন খোলা জায়গায় খাইয়াছি। আজ আমরা না হয় একটু দামি রেস্টুরেন্টেই মধ্যাহ্নভোজ করিলাম!
কথা: আমি রাজি বটে, তবে, ওইখান হইতেই বাড়িতে যাইবো, অফিসে আজ আর ফিরিব না।
কেমন যেন একটা অনুভুত হইতেছে। তুমি সবকিছু ঠিকঠাক ব্যবস্থা করিয়া লইবে।
আকাশ: যথা আজ্ঞা মহারাণী!সেটা তুমি আমার উপর ছাড়িয়া দাও।
বিগত দিবসের রিপোর্টের কর্ম সম্পাদন করিতেই দুপুর গড়াইয়া আসিল।
মনির(পিওন): আকাশ ভাই বস আপনাকে সালাম জানাইয়াছেন। অফিসের অন্য সকলকে মনির স্যার আর ম্যাডাম বলিয়া সন্মোধন করিলেও আকাশকে ভাই আর কথাকে আপু বলিয়া সন্মোধন করে।সেইটা অবশ্য আকাশ বলিয়াছে তাই।
আকাশ:আসতে পারি স্যার?
বস: হ্যাঁ, আসিতে পার।
বস: আচ্ছা আকাশ গতকালের কার্যাবলী কি পরিপূর্ণ রুপে সাধিত হইয়াছে না কি কিছু বকেয়া রহিয়াছে? মেইল গুলো কি প্রেরণ করা হইয়াছে?
আকাশ: গতকালের কাজ গুলো কেবলমাত্র সমাপ্ত হইল।
আকাশ: স্যার! একটা কথা বলিবার ছিল।
বস: বলো।
আকাশ: আপনি যদি একবার চেক করিয়া দিতেন তবে মেইলে গুলো সেন্ড করিয়া একটু বাহিরে খাইতে যাইব। দুপুরের পর একটু ব্যক্তিগত কাজ আছে।সুতরাং,আজ আর অফিসে ফিরিয়া আসিব না।
বস:তাহা হইলে কিভাবে হইবে? আজকের সকল কাজ তো বকেয়া থাকিয়া যাইবে!
আকাশ: আমি আগামীকাল আসিয়া সকল কাজ একসাথে সম্পাদন করিয়া তারপর বাড়িতে যাইব, ইনশাআল্লাহ্!
বস: ঠিক আছে।যাও।তবে,কথাকে একটু বুঝাইয়া দিয়া যাও। ও যতটুকু পারিবে ততটুকু যেন আগাইয়া রাখিয়া দেয়।
আকাশ: স্যার! কথা সকালে অফিসে আসিতে যাইয়া ভিজিয়া গিয়াছে। ও বলিতেছিল: শরীরটাও না কি তেমন ভাল নয় তাহার।
বস: তাহার মানে, সে ও চলিয়া যাইতে চায় আজ?
আকাশ: জ্বী, স্যার। আগামীকাল আসিয়া সকল কাজ যথাযথ ভাবে সম্পাদন করিয়া তবেই গৃহে ফিরিব, ইনশাআল্লাহ্!
বস: আচ্ছা, ঠিক আছে।মনিরকে একটু পাঠাইয়া দাও।আমি বাসায় যাইয়া খাইয়া আসিবার পর বেশ কিছু কাজ করিতে হইবে। তোমরা অফিসের সকলে ছুটি লইতে চাহিলেও আমার বেলায় তো আর তা করিলে চলে না। ঠিক আছে, যাও।
আকাশ: (বসের কক্ষ হইতে উৎফুল্ল চিত্তে বাহির হইয়া মনির কে উদ্দেশ্য করিয়া) বস তোমাকে ডাকিতেছেন।উনি বোধকরি বাহির হইবেন।
কথা: আমার ছুটির কি কোন বন্দোবস্ত হইল?
আকাশ: জ্বী, মহাশয়া!সে কর্ম আমি সম্পাদন করিয়াই আসিয়াছি।
বস: বাহিরে আসিয়া (পশ্চাতে মনির ব্রিফকেস হস্তে)।কি খবর! তোমরা যাওনি?
আকাশ ও কথা একত্রে: না স্যার এখনই বাহির হইব।
বস: ঠিক আছে। আমি তাহলে বাহির হইলাম। তোমরাও চলিয়া যাও।
আকাশ ও কথা: (সমস্বরে): জ্বী, স্যার !
আকাশ: চলুন মহারাণী!তবে যাত্রা আরম্ভ করা যাক।
কথা: মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য!
অফিস হইতে বাহির হইয়া তাহারা একখানা রিক্সা ভাড়া করিয়া সোজা হোটেল নবাবের পৌঁছাইল।
আকাশ: (কথাকে): কি খাইবে?
কথা: তুমিই বলিয়া দাও।
আকাশ: লেডিস ফার্স্ট।
কথা: আমি শুধু সব্জি আর সাদা ভাত খাইব। তুমি কি খাইবে?
আকাশ: তুমি যা খাইবে আমিও তাই খাইব।
কথা: তবে তো স্ব স্ব গৃহে ফিরিয়া খাইলেই হইত। এইখানে আসছিলাম কেন?
আকাশ: তোমার তো শরীর খারাপ। তোমার সাথে সংহতি জানাইলাম।
কথা: বাবা! তোমার সহিত কথায় জিতিয়ে সাধ্য কাহার! আচ্ছা চলো দ্রুত খাইয়া বাহির হইয়া যাই।
আকাশ:মাথা নাড়াইয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিল।
আকাশ: বেল চাপিল।
ওয়েটার: কি খাবেন স্যার?মেনু কার্ড আছে। আকাশ: দুইটা করিয়া সব্জি ও ভর্তা আর দুই প্লেট সাদা ভাত।
খাবার পরিবেশন করা হইল। খাওয়া সমাপ্ত করিয়া বিল (পরিশোধ করিয়া) দুই জনেই হোটেল হইতে বাহিরে আসিল।
আকাশ: এখন কোথায় যাইবে? বাসায় নিশ্চয়? চলো, তোমারে বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিয়া তারপর আমিও ফিরিব।
কথা: জ্বী, না মহারাজ! আমি বাড়িতে ফিরিতেছি না।আজ তোমারে সময় প্রদান করিব।
আকাশ: তোমার তো শরীর খারাপ।
কথা: তোমার জন্য এটুকু আত্মোৎসর্গ তো করিতেই পারি আমি।
আকাশ:এই তুমি আমারে এত ভাল বুঝিতে পারে কিভাবে?
কথা:ওটা একটা গোপন রহস্য।এটা আমি প্রকাশ করিতে চাহি না।
আজ বিকালে বৃষ্টি আর আসেনি ধরায়।পূর্ব দিগন্ত রেখা বরাবর একটু উপরে সাতরঙা রঙধনুর রঙের ম্রিয়মাণ বিচ্ছুরণ। সমস্ত বিকালটা তাহারা ঘুরিয়া-ফিরায়া বেড়াইল হর্ষ-আমোদ। এরই মধ্যে আকাশ আবিষ্কার করিল কথার নেত্র হইতে বিসর্জিত হইতেছে জলধারা।
আকাশ: কাঁদিতেছ কেন? শরীর কি খুব খারাপ?
কথা:না গো! ভয়ে ভীত হইয়া কাঁদিতেছি।
আকাশ: কিসের ভয়?
কথা: তোমাকে হারাইবার ভয়।
আকাশ: তুমি তো এতদিনে নিশ্চয় চিনিয়াছ আমি কেমন!
কথা: তোমার প্রতি বিশ্বাস ছিল, আছে থাকিবেও।
আকাশ কথার চোখের জল মুছাইয়া দিতেই কথা আকাশকে জড়াইয়া ধরিল। আকাশও শক্ত করিয়া জড়াইয়া ধরিল কথাকে।
কথা: এভাবেই আমাকে তোমার বক্ষ মাঝে আগলাইয়া রাখিও আকাশ।
আকাশ: তুমি তো আমার শ্বাস-প্রশ্বাস! তোমারে ছাড়া আমার চলিবে কি করে বলিতে পার?
আকাশ ও কথা আরও শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হইল।আলতো করিয়া চুম্বন করিল একে অপরকে।
অত:পর, বেশ কিছুটা সময় এভাবেই অতিক্রান্ত হইয়া গেল।
কোন কেউ একজন বলিয়া উঠিল: বাসায় ফিরিবেন না স্যার?
অকস্মাৎ ঘুম ভাঙিল তাহার। সে যে স্বপ্ন দর্শনে মত্ত ছিল।