স্নিগ্ধ প্রেমের পরশ (গল্প)
নাহিদা সুলতানা
রাতের শহর।চেনাজানা সব অলিগলিগুলো ছাপিয়ে হইচইগুলো থেমে আছে। স্তব্ধতার মায়াজালে চারিপাশ থমথমে।অভ্র অচেনা পথিকের মতো হেঁটে চলেছে আর দু-হাত ঘষতে ঘষতে মনে মনে ভাবছে, আকাশের চাঁদটাও বুঝি বিদ্রুপ করছে রাতের শহরকে নিয়ে “কোথায় তোমার ব্যস্ততা? কোথায় তোমার এত গুঞ্জন?” কিন্তু সেই বিদ্রুপ কি অভ্র ব্যতীত শুনতে পাচ্ছে অপর কোন সত্তা? নাকি শুধুই তার ভ্রম!কে জানে। এখন অগ্রহায়ণ মাস। শীতটা তেমন জেঁকে বসেনি এখনো। দিনের বেলায়তো বেশ গরম তবে সন্ধ্যার পর একটু একটু ঠান্ডা। কোন কোন দিন কুয়াশাজড়ানো। রাত মোটে নয়টা, চারিদিকে ধোয়া ধোয়া একটা ভাপসা অবস্থা মনে হচ্ছে আজও কুয়াশা পড়বে।অভ্র একাকী মনে হাঁটতে হাঁটতে বাংলামোটর মোড়ে সিগনালের সামনে এসে দাঁড়ায়। যথেষ্ট ভিড়। এতক্ষণও চারিপাশ জনশূন্য ছিল। সহসা সবুজ বাতির অপেক্ষায় পথচলতি সাধারণ মানুষের আনাগোনায় অভ্র কিছুটা হতচকিত হয়। তার চেয়েও দেদার বিস্ময় তাকে জেঁকে ধরে যখন রিনরিনে কণ্ঠস্বরের কোন অধিকারীনি তাকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে।
“আপনার কাছে দশ টাকা ভাংতি হবে?”
অভ্র পেছন ঘুরে তাকায়।আকস্মিক নারী কণ্ঠের ডাকে সে ভীষণ হতচকিত। সে এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইশারায় প্রশ্ন করে,”আমাকে বলছেন?” ততক্ষণে ভিড় সংবলিত রাস্তাটা জনশূন্য হয়ে গিয়েছে।মেয়েটি ঠোঁট উলটে উত্তর দেয়, “এখানে আপনি, আমি ছাড়া আর কেউ আছে কি?”
“অভ্র এদিক সেদিক দেখে মাথা নাড়ায়।মেয়েটি হাত বাড়ায় অভ্রের দিকে। অভ্র পুনরায় একরাশ বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে চেয়ে রয়।মেয়েটি বলে ওঠে, “দিন না ১০ টাকা ভাংতি? ১০ টাকাই তো। এমন তো না ৫০০, ১০০০ চেয়েছি!”
“অভ্র ভাবে, ১০ টাকাও আবার কারো ভাংতি লাগে নাকি? যাই হোক অভ্র ১০ টাকার দুটি নোট তার মানিব্যাগ থেকে বের করে মেয়েটির সামনে ধরতেই মেয়েটি মুচকি হেসে ২০ টাকার একটা নোট অভ্রকে ধরিয়ে দিয়ে তার থেকে নোট দুটি নিয়ে পাশে থাকা রিক্সাওয়ালা মামাকে দিয়ে দেয়।এবার অভ্রের তাবৎ বিস্ময়ের ইতি ঘটে।সে বুঝতে পারে কেন মেয়েটির এত রাতে অকস্মাৎ ১০ টাকা ভাংতির প্রয়োজন পড়লো।”
মেয়েটি তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বলে, চলুন।অভ্র বারংবার বিস্মিত হচ্ছে মেয়েটির সখ্যতা দেখে।
“আপনি কি কথা বলতে পারেন না?”
“অভ্র এবারো নিরুত্তর”
“আরে কিছু জিজ্ঞেস করছি আপনাকে।”
“অভ্র অবশেষে মুখ খোলে। জি বলুন।”
“যাক কথা বলতে পারেন তাহলে আমিতো ভেবেছি বোবা”
“মেয়েটির রসিকতা বুঝতে পারলেও অভ্র বিষয়টা যেন এড়িয়ে যেতে চাইছে। অভ্র একটা মিথ্যা হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে চলে যেতে থাকলে মেয়েটিও তার সাথে যেতে থাকে। অভ্রের মেয়েটির হাব-ভাব ঠিক লাগছেনা। সে সোজা হাঁটতে থাকে। মেয়েটিকে আড়চোখে দেখে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করে অভ্র। বয়স ২৩, ২৪ হবে। গায়ে চাদর জড়ানো। খোলা চুলগুলো মৃদু সমীরণে দুলছে। ঠোঁটে মৃদু হাসির আভায় গালে হালকা টোলের সৃষ্টি। ঘন পাপড়িগুলো তার নয়নজোড়ার দিকে তাকাতে যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। কিন্তু মেয়েটির শান্তমনা ভাবও অভ্রের মনে ভীরুতার সঞ্চার কমাতে পারেনা। অগত্যা একটা যুবতী মেয়ে এত রাতে কোন উদ্দেশ্যহীনা অপরিচিত একটা ছেলের সাথে কোন দুঃখে এত সখ্যতা দেখাতে যাবে! এই ভাবনাটাই অভ্রকে মেয়েটিকে ঘিরে ইতিবাচক মননশীলতায় ক্লিষ্ট করতে পারছেনা।”
“মেয়েটি এই ছিমছাম পরিবেশটায় বিদ্বিষ্ট হয়ে অভ্রকে প্রশ্ন করে,
“আপনিতো দেখছি অনেক চুপচাপ।কোন ছেলেকে আমি আজ অবধি দেখিনি মেয়ে মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর সে এত চুপচাপ। যাই হোক ছাড়ুন।আমি কুয়াশা। আর আপনি?”
“সৌজন্যতার খাতিরেই হোক আর মেয়েটির উদ্দেশ্য জানার নিমিত্তেই হোক এবার অভ্র জবাব দেয়,
” অভ্র।আমার নাম অভ্র।”
“ওও আপনার আমার নামটা বেশ মিলেছে কিন্তু।অভ্র-কুয়াশা। এই বলেই মেয়েটা মিষ্টি একটা হাসি দেয়। অভ্র কেবল মেয়েটিকে দেখে অবাকই হচ্ছে।”
“মেয়েটির বারবার সেধে প্রশ্ন জিঘাংসাতে অভ্রও সাহস করে এবার প্রশ্ন শুধে,
“আপনি কি করেন?”
“আমি! আমি খবরের কাগজে চাকরি করি” (কুয়াশা)
“ওও। তার মানে আপনি সাংবাদিক” (অভ্র)
“উহু।মোটেই না।আমি কোন সাংবাদিক নই।”
“তাহলে,”
“আমি একজন সহকারী বার্তা সম্পাদিকা” (ম্লান হেসে)
“রিপোর্টার হলেই তো ভালো ছিল” (আনমনে)
“তা কি ভালো ছিল? আপনিতো বেশ জানেন দেখছি আপনি কি মিডিয়ার লোক? কি করেন আপনি?”
“না আমি কোন মিডিয়ার লোক নই।তবে সাংবাদিকতায় পড়েছি অবশ্য। চাকরি হয়নি কোন।তাই পথে পথে ঘুরি।”
“কুয়াশা ভ্রুযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে আবারো মুচকি হেসে বলে তাতে কি হয়নি! হবে,,,।আচ্ছা আপনি কাল বিকেলে আমার সাথে দেখা করবেন?”
“এটা শুনে অভ্র অবাকের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, কেন?”
“আহহা এত প্রশ্ন করেন কেন? দেখা করবেন বলেছি করবেন। আর হ্যাঁ সাথে আপনার সিভিটা নিয়ে আসবেন কিন্তু। আর দুই কপি ছবি”
“অভ্র এবার বুঝতে পেরে ম্লান হেসে বলে, কিন্তু আমিযে অফিসে চাকরি করতে চাইনা। এখন যে চাকরি করি সেটাই ভালো।”
“ওমা সেকি এক্ষুনি না বললেন আপনি বেকার।”
“অভ্র এবার হেসেই ফেলে।আর বলে, এটাইতো আমার চাকরি। ঘোরাঘুরির চাকরি।”
“মেয়েটা ফিক করে হেসে দেয় অভ্রের কথায়। তার হাসি যেন থামছেইনা। অভ্র এক অজানা কারণে, অচেনা টানে মেয়েটির হাস্যোজ্জ্বল চাহনির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে, এভাবে কেউ রসিকতা করে। এই বলে সে আবারও হাসতে লাগে।কুয়াশার রাতে নিয়ন আলোর নিচে সদ্য পরিচিত মেয়েটা যেন অপরিচিতা থেকে খুব কাছের কেউয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কোন চেনা সুর, অচেনা রঙ অভ্রকে এই মায়ার অতলে জর্জরিত করছে তা তার স্বীয় সত্তারোও অজানা।”
হঠাৎই মেয়েটা অভ্রের হাত আকড়ে ধরে।অভ্র ভ্রম থেকে বেরিয়ে আসে।তার চোখে বিস্ময়, হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই ঠান্ডা মৌসূমেও এক অদ্ভুত শিহরণ তার মাঝে খেলে যাচ্ছে অহেতুক যেজন্য তার ললাট বেয়ে ঘর্ম যেন বর্ষারূপে ঝরছে।মেয়েটি তাকে ইশারা করে, দেখুন বাদাম। এই বলে মেয়েটা ঠোঁটে তার শিহরণ জাগানো হাসি বজায় রেখেই অভ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাদাম খাবেন? নেই?”
“অভ্র নিরুত্তর।সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা কি বলবে।এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে কেউ এমন মুগ্ধতা প্রকাশ করতে পারে বুঝি! বিস্ময় যেন অভ্রকে আড়াল করছে তারি মাঝে বারংবার। কুয়াশা অভ্রের উত্তরের আশায় না থেকে দুই ঠোঙায় বাদাম কিনে অভ্রের কাছে ফিরে আসে। আর এক ঠোঙা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরেক ঠোঙা থেকে বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে হাঁটতে থাকে।”
“জানেন অভ্র।বাদাম না আমার ভীষণ পছন্দ। এ পর্যন্ত আমি মনে হয় এক কোটি প্লাস বাদাম খেয়েছি। আমার কি মনে হয় জানেন আমি মরে গেলে নিশ্চয়ই ভৈরব বাদাম ব্যবসায়ী সমিতি শোক বিবৃতি দিবে।”
“মেয়েটির রসিকতা নাজুক অভ্রের মুখে কিঞ্চিৎ হলেও হাসির আভা প্রস্ফুটিত করতে সক্ষম হয়েছে। অভ্রও এবার তাল মিলিয়ে বলে, “হুম সেই বিবৃতিতে লিখা থাকবে মাননীয়া কুয়াশার মৃত্যুতে বাদাম ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”
“মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে ততদিনে আপনি নিশ্চয়ই প্রফেশনাল রিপোর্টার হয়ে যাবেন। তখন আপনাকেই ছাপতে হবে কিন্তু। বানান, বাক্যে কোথাও যেন ত্রুটি না থাকে। কারেকশন আপনি করবেন কেমন?”
“অভ্রের মনে জেঁকে বসা সন্দেহটা এতক্ষণে দূরীভুত হয়ে গেছে।সে প্রত্যুত্তরে বলে, কিন্তু আপনার ছবি ফুল কলাম যাবেনা কি হাফ কলাম? যাই হোক তা অবশ্য আমাদের সম্পাদক ঠিক করবেন কি বলেন?”
“না না ফুল কলামই নিয়েন একবারই তো”
“এবার দুজনেই হাসতে শুরু করে।হাসতে হাসতে তাদের পেটে যেন খিল ধরে যায়।হাসি থামলে বাদামের খোসাগুলো কুয়াশা ফু দিয়ে নির্মল প্রভঞ্জনে উড়িয়ে দেয়।”
এবার বিদায় নেয়ার পালা।রাত এখন ১০টা বাজতে কিছু মুহূর্ত বাকি। কুয়াশা একটা বটগাছের সামনে এসে থামে।অভ্রের দিকে ফিরে বলে আপনি বেশ মজার মানুষ।পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো। নয়াপল্টনে আমার কর্মস্থল।মোড়টা যেখানে আছে না সেখান দিয়েই প্রতিদিন বাসায় ফিরি। চাকরির অফারটা যদি কোনদিন এক্সেপ্ট করতে ইচ্ছে হয় তাহলে হাজির হয়ে যেয়েন ওই মোড়টাতেই। আজ যেখানে হলো প্রথম সাক্ষাৎ।আবার দেখা হবে কোন একদিন। আসি।
একদমে কথাগুলো বলে গেল কুয়াশা।অভ্রও তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
বাবা-মা ছোটবেলাতেই মারা গেছে অভ্রর। সে মামার কাছে বড় হয়েছে। খুব চুপচাপ আর চাপা স্বভাবের সে।সহজে কারো সাথে মিশতে বা কথা বলতে পারেনা।নেহাৎ কুয়াশা মেয়েটা সেধে এত প্রশ্ন শুধায় অভ্রের মাঝেও কিঞ্চিৎ তার বৈশিষ্ট্য ধরা দিয়েছিল।মেসে ফিরে অভ্র তার জ্যাকেটটা খুলতেই পায়ের কাছে ঝনঝনিয়ে একটা শব্দ হয়।নিচে তাকাতেই অভ্র ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে ফেলে। একটা দুল পড়ে আছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি পড়লো যখন সে তার জ্যাকেটটা খুললো। এটাতো কুয়াশার দুল।ওর কানে দেখেছিলাম। কিন্তু এখানে কি করে এলো! ভাবতে ভাবতে অভ্র সেটা তুলে নিল। নিশ্চয়ই কুয়াশা যখন তাকে আকড়ে ধরেছিল তখন এটা খুলে এসে তার জ্যাকেটে আটকে গেছে। কিন্তু এখন সে এটা কি করে দিবে! এসব চিন্তাই অভ্রকে জেঁকে ধরেছে এমন সময় তার রুমমেট আসিফ অভ্র বলে ডাকতে ডাকতে হনহনিয়ে ঘরে ঢোকে। অভ্র বিচলিত হয়ে ফিরতেই আসিফ অভ্রের হাতে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে, “নে তোর চিঠি”
“অভ্র ললাট কুঞ্চিত করে বলে, আবার?”
“হুম আবার”
“অভ্র বিরক্তি নিয়ে খামটা টেবিলে রেখে দুলটার দিকে দেখতে থাকে। দুলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা কুয়াশার প্রতিচ্ছবি তার সামনে প্রস্ফুট হয়। সেই রিনরিনে কণ্ঠস্বর কানে বাজতে থাকে তার। বাদাম খাবেন? জানেন বাদাম না আমার ভীষণ পছন্দ।অভ্রর অজান্তেই তার ঠোঁটের কার্নিশে মৃদু হাসির আভা ঝলমলিয়ে ওঠে।সে সাদা রুমালে কানের দুলটা যত্নসহকারে আড়াল করে তার বুকপকেটে রেখে দেয়। আসিফ এতক্ষণ তার কাহিনি দেখছিল। অভ্র আসিফের চাহনি দেখে কিছুটা লজ্জা পায়। এরপর টেবিল থেকে চিঠির খামটা নিয়ে চিঠিটা বের করে বিরক্তি সহকারে পড়তে শুরু করে।
“মিস্টার জেলিফিশ, শুরুতেই, কাঠগোলাপের একমুঠো শুচিশ্রভ্র ভালোবাসা নেবেন। আজ চিঠিটা দিতে একটু দেরি হয়ে গেল। অপেক্ষা করছিলেন বুঝি! আজ কতগুলো দিন পার হয়ে গেল বলুন। আমার হৃদয়জ আঙিনায় ভালোবাসার কান্তিমানতায় যে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে তার যেন কোন ইতিবৃত্তই খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। আপনার মনেও কি সেই চিত্তাকর্ষক অনুভূতি আন্দোলিত হয়? এই ভাবনা আমার অবুঝ মনে যদিও জেগেছে বারংবার কিন্তু উত্তর খোঁজার বৃথা প্রচেষ্টায় হইনি আমি নিমগ্ন। জানেন কেন? না না থাক এই কেনটা না হয় পরের চিঠিতেই জানাবো ক্ষণ।শুধু জেনে রাখুন আমার সত্তা আমাতে হয়েছে নিখোঁজ যেদিন আপনি নামক সত্তাটি এ সত্তার জীবনে বসন্তের শুভ্রতা নিয়ে এসেছিলেন। আমি প্রতিটি ক্ষণ অপেক্ষমান থাকি কখন কাজের ফুরসৎ মিলবে আর আপনার নিকট চিঠি লিখতে বসবো। চিঠি দিতে গিয়ে আপনার কোন বার্তাবাহক আপনার হৃদয়চিত্তের শব্দগুচ্ছ নিয়ে হাজির হবে আমার সামনে এই দূরদর্শী ভাবনা সতত আমাকে ঋদ্ধ করে অহেতুক। আচ্ছা আপনি আমার চিঠির জবাব কবে দেবেন? আর কত অপেক্ষমান থাকবো? এক অপেক্ষা নামক অপ্রাপ্ত তিয়াস যে আমায় প্রতিনিয়ত সিক্ত করে সহস্র ভাবগাম্ভীর্যে। তবু আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান রইলাম আমার সামুদ্রিক ভিমরুল মিস্টার জেলিফিশ কেবল আপনার নিমিত্তে।নিশ্চয়ই কোন একদিন আপনিও আমার ভাবনায় ঋদ্ধ মননিবেশে আবিষ্ট হবেন।
ইতি
আপনার আকাঙ্ক্ষিনী
একরাশ বিরক্তি নিয়ে চিঠিটা পড়া শেষ করে অভ্র সেটা ড্রয়ারে রাখতে নিতেই আসিফ তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করে।চিঠিটা পড়ে আসিফ অভ্রের কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে চিঠির জবাব দিচ্ছিস না কেন? মেয়েটা আজ ৬ সপ্তাহ যাবৎ লেটার বক্সে চিঠি পাঠিয়ে চলেছে।কখন যে আসে আর কখন যে যায় টেরই পাইনা।কিন্তু তুই চিঠিগুলো এত স্ব-যত্নে রেখে দিয়েছিস কেন? হয় ফেলে দে নয় মেয়েটাকে খুঁজে প্রেম কর।এমন কাঙালদের মতো আর কতদিন চলবি?”
“একদমে আসিফ কথাগুলো বলে গেলেও অভ্র তার কথায় তেমন বিচলিত হয়না। খুবই শান্ত স্বরে সে জবাব দেয়,
“একজনের খুব যত্নে গড়া ভালোবাসা জড়ানো আত্মকথন।কি করে অগ্রাহ্য করি বল! তাই আমিও খুব যত্নেই রেখেছি তার আবেগ জড়ানো চিঠির আলাপন। কোন একদিন দেখা যদি হয় ফিরিয়ে দিবো নাহয় যত্নের আদলে গড়ে তোলা এই চিঠির স্তুপ।কিন্তু এগুলো ফেলে দিয়ে একটা মেয়ের মনোহর হৃদয় কথনকে আমি অবজ্ঞা করতে পারবো না।”
“আসিফ বিমোহিত হয়ে অভ্রর কথাগুলো শোনে।তবে তার মনে প্রশ্ন জাগে, অগত্যা অভ্রকে জেলিফিশ বলে সম্বোধন করার কারণ কি? এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই অভ্র ড্রয়ার থেকে নীল রঙের চিঠির খামটা বের করে আসিফের হাতে দিয়ে বলে এটা পড় তাহলে বুঝতে পারবি” আসিফ পড়তে শুরু করে, মিস্টার জেলিফিশ, আশ করি হেমন্তের শুভাগমনে আপনি নামক সত্তাটি শুভ্রতার আদলে বেশ ভালোই আছেন। কিন্তু জানেন আমিও ভালো ছিলাম বেশ। তবে ভাপসা গরমের সন্ধিক্ষণে মৃদু সমীরণের আভাস পেয়ে কোন এক অপরিচিত সত্তার শুভাগমন উপলব্ধি করতে পেরে যখন নিয়ন আলোর নিচে দাঁড়ালাম আপনি নামক সত্তাটি সামুদ্রিক ভিমরুলের মতো আমার সামনে উদিত হলেন। সেই তখন থেকেই আমার ভালো থাকার কারণটা উধাও হয়ে গেল।আপনি নামক সত্তাটি আমাকে বড্ড বিরক্ত করেন এখন। তাইতো বাধ্য হয়ে চিঠির আদলে আমিও হতে এলাম আপনার বিরক্তির কারণ। জানেন! পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত প্রাণী কাকে বলা হয়? জেলিফিশ। যাকে সোজা বাংলায় বলা যায় সামুদ্রিক ভিমরুল। আপনি নামক সত্তাটিকে আমার দেওয়া এই নামটা ভীষণ মানাবে কিন্তু! সে সময়টা ছিল সন্ধিক্ষণের পর মুহূর্ত, নিয়ন আলোর নিচে আবছা আলোয় এক বিস্ময়কর মোহনীয়তার আভাস ফুটে ছিল এক সত্তার চাহনিতে। সাংকেতিক ভাবে যে তার আবেগ প্রকাশ করে, অহেতুক শব্দ করা যেন তার বড্ড অপছন্দ। তাই নাম দিয়েছি তার জেলিফিশ। জানেন কে সে? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আপনি।ছোট বাচ্চাগুলোকে যখন খুশি করার দেদার প্রচেষ্টায় আপনি রত ছিলেন আমি অজানা মুগ্ধতাতে আপনি নামক সত্তার অতলে হারিয়ে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের নিমিত্তে।আজ দু-দিন যাবৎ এই আপনি নামক সত্তাটি আমার স্বাপ্নিক জগতে এসে আমায় বড্ড বিরক্ত করেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ থেকে আমিও আপনার নিয়মিত বিরক্তির নিমিত্ত হিসেবে রচনা করব এক শাণিত আখ্যান।
ইতি
আপনি নামক সত্তার আকাঙ্ক্ষায় ক্লিষ্ট-জীর্ণ
এক আকাঙ্ক্ষাীনি।
আসিফ চিঠিটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যায়।সে অভ্রকে বলে,
“আমি ভেবেছিলাম অন্য সব মেয়েদের মতোই এই মেয়েটাও তোর উপর ক্রাশ খেয়ে জাস্ট তোকে চিঠি পাঠাচ্ছে।কিন্তু চিঠিটা পড়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটা কতটা আবেগ নিয়ে, কতটা যত্নের সাথে এই চিঠিটা তোর জন্য লিখেছে। আর কারোও এত যত্নে গড়া ভালোবাসার বিপরীতে তুই তাকে কি দিচ্ছিস অভ্র! এক চিলতে অবহেলা? অনিশ্চিত অপেক্ষমানতা?”
“অভ্র আসিফের কথায় ম্লান হাসে। এরপর তাকে জবাবে বলে,
“আমি চিঠি পড়েই বুঝেছি মেয়েটা অন্য সব মেয়েদের মতো নয়রে। তাই জন্যই ওর চিঠিগুলোর জায়গা আমার পার্সোনাল ড্রয়ারে দিয়েছি। কিন্তু এর বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“কেন সম্ভব নয়? ভালোবাসাকে যত্ন করতে হয় অভ্র। এটা সেরূপ ফুলের বাগানের অনুরূপ যেটা যত্নে গড়লে সহস্র ফুলের ঘ্রাণে বাগান আরো সতেজময় হয়ে উঠবে আর যত্ন না করলে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ফুলটার পাপড়ি গুলোও এক সময় ঝরে পড়ে যাবে।”
“আমার অনিশ্চিত জীবনে কোন প্রস্ফুটিত ফুলের জায়গা হতে পারেনা রে!বরং অনিশ্চয়তার আদলে সেই ফুলটা অচেনা অতলে ঢাকা পড়ে যাবে।”
“আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠির খামটা অভ্রর হাতে দিয়ে বলে, “ভেবে দেখ অভ্র।মেয়েটা তোর ব্যাপারে সবটা জেনেই এতদূর এগিয়েছে।তার ভালোবাসাকে এভাবে উপেক্ষা করিস না। একটা সুযোগ পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। তাই বলছি সময় থাকতে ভেবে নে।” “আসিফ অভ্রকে এসব বলে চলে গেলে অভ্র চিঠিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সযত্নে পুনরায় চিঠিটা বাকি চিঠিগুলোর সাথে রেখে দেয়। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে অভ্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।কিন্তু আবারো সেই কুয়াশা মেয়েটার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে তার সামনে। অভ্র আবারো চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করে কিন্তু মেয়েটার রিনরিনে কণ্ঠস্বর, তার শুভ্রতাসিক্ত চাহনি অভ্রের বিভাবরীর তন্দ্রায় এক বিশাল ছেদ ঘটিয়ে বারংবার দোলা দিচ্ছে।”
রাতে অভ্রের একটুও ঘুম হয়নি।কয়শত বার যে মেয়েটির চেহারা তার চোখের সামনে প্রস্ফুট হয়েছে তা অভ্র নিজেও বলতে পারবেনা।ঘড়ির কাটায় সকাল ১০টা। অভ্র সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায় রত থেকে হুমায়ুন আহমেদের “শুভ্র” বইটা হাতে নিয়ে পড়তে বসে যায়। বইয়ের আদলে মুখ গুজে সারাটাদিন পার হয়ে গেলে সন্ধ্যা নামতেই অভ্র হনহনিয়ে বাংলামোটর মোড়ের সেই সিগনালে এসে পৌঁছায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। অভ্র ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে একবার, রাস্তার পথচলতি মানুষদের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার। কিন্তু কুয়াশা জড়ানো রাতের শহরে কুয়াশার আগমন আর ঘটেনা।ঘড়িতে ১০টা বাজতে এখনো কুড়ি মিনিট বাকি। অভ্র বুকপকেট থেকে দুলটা বের করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আর অপ্রাপ্ত তিয়াসা নিয়ে মেসের দিকে রওনা হয়। পরদিন আবারো একই ভাবে অভ্র মোটরমোড়ের সিগনালে এসে যথাসময়ে হাজির হয়। কিন্তু আজও কুয়াশা আসেনা। অভ্রের মনে প্রশ্ন জাগে, আদও কি কুয়াশা নামের কারো সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল? নাকি এ তার শুধুমাত্র এক ভ্রম! কিন্তু তা কি করে হয়! এমনই যদি হতো কানের দুল কোথা থেকে এলো। এসবই ভাবতে ভাবতে অভ্র মেসে ফিরে আসে।দিন যায়, ক্ষণ যায় প্রতিটি দিন অভ্র যথাসময়ে সেই মোটরমোড়ের সিগনালে এসে থামে।কিন্তু কোন অজানা টানে, কোন অচেনা সুর তাকে টেনে আনে তা তার নিজেরও অজানা। আজ ১ সপ্তাহ যাবৎ অভ্র এই রুটিন মোতাবেকই চলছে। যথাসময়ে সিগনালে এসে দাঁড়ায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কিন্তু কুয়াশা আর আসেনা। সেই আকাঙ্ক্ষীনির চিঠিও কেন যেন আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাতদিন হয়ে গেল চিঠির মেয়েটা আর চিঠি নিয়ে আসেনা, কুয়াশাও আর নিয়ন আলোর নিচে অকস্মাৎ আগমন ঘটায়না। তবে কেন স্নিগ্ধ প্রেমের পরশ তার সমগ্র সত্তাকে ছুয়ে দিয়ে মুহূর্তমাঝে বিলীন হয়ে গেল!সেই স্নিগ্ধতামাখা হাসি, তার চাঞ্চল্যপনা যে অভ্রকে সম্পুর্নভাবে স্তম্ভিত করে দিয়ে হারিয়ে গিয়েছে অকস্মাৎ। এসব ভাবতে ভাবতেই অভ্র ফিরে যায় তার মেসে।
আজ অভ্রের মনটা ভীষণ উদাসীন। এক সপ্তাহ যাবৎ কুয়াশার ভাবনাতে সে পার করছে সময়। অথচ, সে কিনা একবার দেখা দিয়েই বিলীন হয়ে গেল! আরকি কখনো হবেনা দেখা! আসিফ তার উদাসীনতার কারণটা মেনেই নিতে পারছেনা।কোথায় সপ্তাহখানেক ধরে এক আকাঙ্ক্ষীনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অভ্রের চিঠির উত্তরের আর সেখানে অভ্র কিনা কোন অপরিচিতার প্রথম সাক্ষাৎকারে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। এ বিষয়টা যেন তার হজমই হচ্ছেনা।কিন্তু অভ্রকে তো তা বলে লাভ নেই।সে একগুঁয়ে আর নিজ সিদ্ধান্তে সর্বদাই অটল।অভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ শেষবার যাবে সেই সিগনালে কুয়াশার দেখা যদি মেলে! চিঠির মেয়েটার কি হলো! কেন সে এখন আর আসেনা এই ভাবনাটাও তার মনে ঝঞ্ঝা তুলে চলেছে। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে সেই চিঠির মেয়েটা দেরিতে হলেও আসবেই। এই বিশ্বাসই তাকে মেয়েটার ব্যাপারে তেমন চিন্তাক্লিষ্ট করতে পারছেনা। সারাটাদিন নানান প্রশ্নের গুঞ্জনে নিজেকে আড়ালে আবডালে রেখে যথাসময়ে সে পৌঁছে যায় মোটরমোড়ের সিগনালে। হঠাৎই পথে দেখা হয়ে যায় সেই বাদামওয়ালার সাথে। তাকে দেখে যেন অভ্রর ঠোঁটের কার্নিশে ফুটে ওঠে শিহরণ খেলা হাসি। সে ঠিক সেদিনের মতোই দুই ঠোঙা বাদাম কিনে নিয়ে তার প্যান্টের পকেটে মুড়ে রেখে দেয়। ঠোঁটের হাসি জারি রেখেই অভ্র সিগনাল পার হতে থাকে। অগত্যা একটি স্থানে অনেক মানুষের ভিড় দেখে সে অবাক বিস্ময়ে বুঝতে চেষ্টা করে সেখানে কি হচ্ছে। যদিও অভ্র ভিড়ভাট্টা সবসময়ই এড়িয়ে চলে তবে কেন যেন এক অচেনা টানে সে ভিড়ের দিকেই অগ্রসর হয়।তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে চলেছে যার অর্থ সে বুঝতে পারছেনা। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই সামনের দৃশ্য দেখে কেবল সে নয় তার সমগ্র সত্তাই স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে যায়। অভ্রর শরীর চলছেনা, কানে কোন কথা আসছেনা, সে কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছেনা, শুধু কুয়াশার পড়ে থাকা দেহটা দেখতে পাচ্ছে আর আশপাশে থাকা এত মানুষকেও সে শত চেষ্টা সত্ত্বেও দেখতে পাচ্ছেনা। কুয়াশা রক্তাক্ত অবস্থাতেই অভ্রকে দেখে চোখ খুলে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে থাকে। মুখে কিছু বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।কিন্তু মুখ দিয়ে কথা কিছুতেই বের হচ্ছে না। অভ্র যেন তার মুখের ভঙ্গিমা ঠিকই বুঝতে পারছে। কুয়াশা অভ্রকেই ডাকছে কিছু একটা বলতে চাইছে। অভ্রের তা দেখে হুশ ফেরে। সে কুয়াশার পাশ ঘেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কুয়াশার হাতে একটা চিঠির খাম। সে মুঠ করে শক্ত ভাবে ধরে আছে যেন এটা তার জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান।অভ্র তার সেই হাতটাই আকড়ে ধরে শক্ত করে। কুয়াশার লিপসিং দেখে বোঝা যাচ্ছে সে শুধু অভ্রর নামই উচ্চারণ করে যাচ্ছে অনবরত কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পরিস্থিতি যেন তাকে জেঁকে ধরেছে। অভ্রর চোখের কার্নিশে অশ্রু জমে আছে, গলা ফেটে কিছু কথা বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পারছেনা।সে নিজের অশ্রুবিন্দুকে আটকে রেখে বলে,
“ক কু কুয়াশা। এ এসব কি করে হলো!”
“অভ্রর চোখে শেষ মুহূর্তে হলেও তার জন্য ভালোবাসা দেখে কুয়াশা এমন একটা হৃদয়বিদারক প্রহরেও চোখে অশ্রু আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে চোখ বোজে।”
“অভ্র ভয় পেয়ে যায়। সে কুয়াশাকে ঝাকাতে থাকে অনবরত। আর বলতে থাকে এই কুয়াশা।চোখ বন্ধ করবেন না প্লিজ। আ আ আপনার কি কি কিচ্ছু হবেনা। এক্ষুনি এম্বুলেন্স চলে আসবে দেখুন। এই বলেই অভ্র সেখানকার লোকগুলোকে এম্বুলেন্স ডাকার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। কুয়াশার চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসছে কিন্তু তার ঠোঁটের কার্নিশে হাসি এখনো বিদ্যমান। অভ্রর চোখ বেয়ে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কুয়াশার মুখের ওপর। দু-জন দু-জনকে অনেক কিছু বলতে চেয়েও কিছুই বলতে পারছেনা। কিন্তু অনুভবেই বুঝে নিচ্ছে পরস্পরের হৃদয়কথন।অভ্র কুয়াশা কে বলে, “এই কুয়াশা দেখুন আমি আপনার পছন্দের বাদাম নিয়ে এসেছি। আপনিনা বলেছিলেন আপনার কিছু হয়ে গেলে বাদাম ব্যবসায়ীদের অনেক বড় লোকসান হয়ে যাবে। ভুলে গেছেন সেইসব। এত তাড়াতাড়ি যে কথা রাখতে হবে এমন কোন কথাতো ছিল না। প্লিজ চোখটা খোলা রাখতে চেষ্টা করুন। অভ্রর কথাগুলো শুনে ঠোঁটের হাসির রেখাটা আরেকটু বাড়িয়ে কুয়াশা তার হাতের খামটা অভ্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার হাতটা আকড়ে ধরে মুখ হা করে কিছু বলার চেষ্টা করেও পারেনা। পরমুহূর্তেই কুয়াশা অভ্রর হাতটা চেপে ধরে এই সুন্দর পৃথিবী নামক গ্রহটার মায়া ত্যাগ করে এক না ফেরার দেশে চলে যায়। অভ্র নিস্তেজ হয়ে গেছে।চারিপাশে এত কোলাহল কিন্তু তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা কিছুই।কয়েকজন এসে অভ্রকে কুয়াশার হাত থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড় করায়। আর কুয়াশার নিথর দেহটা পড়ে থাকে রাস্তায়। কাপা কাপা হাতে অভ্র তার হাতের খামটার দিকে তাকালে সেখানে লিখা দেখতে পায় আকাঙ্ক্ষীনি। আশেপাশের মানুষগুলো তাকে সহস্র প্রশ্ন করছে।কেউ কেউ এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো সেটা বিস্তারিত বলে যাচ্ছে।
“মেয়েটা সিগনাল পার হয়েই আসছিল।কিন্তু হঠাৎই সিগনাল ছেড়ে দিলে একটা বড় ট্রাক এসে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। মাথা থেকে অনবরত রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় বোঝাই যাচ্ছিলো মেয়েটাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
“এত এত গুঞ্জন কিন্তু কোন কিছুই তার কর্ণগোচর হচ্ছেনা। এম্বুলেন্স এসে অভ্রর চোখের সামনে দিয়ে কুয়াশাকে নিয়ে যেতে থাকে।রাত অনেক হওয়ায় আসিফ অভ্রকে খুঁজতে সেখানে আসলে অভ্রর সাদা শার্টে রক্ত দেখে তার কাছে হনহনিয়ে চলে আসে।অভ্রকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে আসিফ কিন্তু অভ্র আজ শান্ত সমুদ্রের মতো কেবল প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে তার অশ্রুজলের দ্বারা।”
আসিফ অনেক কষ্ট করে অভ্রকে নিয়ে মেসে ফিরে আসে।অভ্র নিস্তেজভাবে বসে আছে। আস্তে আস্তে চিঠির খামটা খুলে সে পড়ার চেষ্টা করে, মিস্টার জেলিফিশ, অনেক অনেক অনেক অনেক দুঃখিত। আজকের চিঠিটা দিতে এত্ত দেরি করার জন্য।আসলে বাবা হঠাৎই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।জ্বর কিছুতেই নামছিলনা। এই সাতদিন আমি কাজেও যেতে পারিনি, না পেয়েছি কোন অবসর, কিন্তু আপনার ভাবনা আমার হৃদয়মাঝে বারংবার দোলা দিয়েছে না চাইতেও। কবে আবার আপনার দেখা পাবো সেই অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছি সাতটা দিন। তবে আপনাকে দেখার জন্য আমার নিখোঁজ সত্তা ক্ষণিকের নিমিত্তেই উত্তেজিত হয়েছে সহস্রবার।জানেন! আমার বাড়ির উঠোনে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে।সে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বাবা বলেন, আমার আসার কথা শুনেই মা এই শিউলি ফুলের গাছটা লাগিয়েছিলেন সেই থেকেই ও আমার বন্ধু।অর্থাৎ জন্মের আগে থেকেই।ভাবছেন এই কথা আপনাকে কেন বলছি? কারণ আছে! কাল বাবা অনেকটাই সুস্থ বোধ করছিলেন তাই আমিও ফুরসৎ পেয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন অনেক বাতাস বইছিল জানেন! শিউলি গাছটা বড্ড বেশি নাচছিল প্রকৃতির মাতাল করা সুরের তালে।শিশির পড়ছিল সমগ্র ঘাসের সরোবরে উঠোন জুড়ে।আমি সারাটারাত সেই শিশিরে ভিজেছি, হেঁটেছি সবুজ ঘাসের আদলে।শুধুমাত্র গাছ থেকে ঝরে পড়া প্রথম শিউলি ফুলগুলো আপনার জন্য কুড়োবো বলে।শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে খালি পা মাড়িয়ে কমলা রঙের নলাকার বোঁটায় সাদা পাপড়ির অজস্র শিউলি ফুল কুড়োনোর যে কি আপামর সুখানুভূতি তা আপনাকে ভাষায় কিকরে প্রকাশ করবো আমার জানা নেই।মনে হচ্ছিলো যেন আমার ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য অশ্রুবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ছে আমারই আদলে। রাতভর মালা গেথেছি সেই ফুল দিয়ে। এই ভাবনাতেই হয়েছি সিক্ত কোন একদিন সেই মালা আমার খোপায় গুজে দেবেন নিজ হাতে।তাই আমার যত্নে কুড়োনো শিউলিগুলোর ম্রিয়মাণ ঘ্রাণ নিবেন প্রিয়।
ইতি
আপনার আকাঙ্ক্ষীনি
অভ্র খামের ভিতরে শিউলি ফুলের মালাটা দেখতে পায়।কেউ এভাবেও ভালো বাসতে পারে! অভ্র তার ভালোবাসার কথা জানানোর আগেই কেন চলে যেতে হলো কুয়াশাকে! পারতোনা কি আরেকটু অপেক্ষা করতে?
অভ্র এখন কুয়াশারই অফিসে রিপোর্টার হিসেবে আছে। সে কুয়াশার কেবিনেই বসে।কুয়াশার ছবিটা এখনো তার কেবিনে পড়ে।অভ্র প্রতিদিন নিয়ম করে কুয়াশার চিঠিগুলো পড়ে। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখে কুয়াশার ছবিটা সামনে রেখে। এখন অভ্র প্রতিদিন চিঠি লেখে আকাশের ঠিকানায়। শহরটা আগের মতোই প্রতি রাত্রি বেলাতেই নিজের রূপ পালটে শান্তরূপ ধারণ করে।সবকিছুই আগের মতো আছে শুধু নেই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর চিহ্ন। কিছু ভালোবাসা হয়তো এমনই অনুভবে তার সুদৃশতা ব্যক্ত করে। কুয়াশা না থাকলেও তার স্মৃতিগুলো আকড়ে অভ্র বাঁচবে।তাকে বাঁচতেই হবে।
নাহিদা সুলতানা